বাংলা লোক শিল্পের অন্যতম অনুসঙ্গ সার্কাস এখন অস্তিত্বের সংকটে । অবহেলা আর উপেক্ষায় প্রায় বিলীন হতে চলেছে একসময়ের জনপ্রীয় এই শিল্পধারা। এক হাতে জীবন আর অন্য হাতে জীবিকা নিয়ে মানুষকে হাসিয়ে আনন্দ দিয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে শারিরীক কসরতের খেলা দেখিয়ে কাটছে যাদের জীবন সেই সার্কাস শিল্পের সাথে জড়িত মানুষেরা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সাথে নিয়ে বিপন্ন জীবন যাপন করছেন।
পঞ্চগড়ের বাণিজ্যমেলায় দিগ্রেট রওশন সার্কাসে খেলা দেখাতে এসেছেন সাতক্ষিরা জেলার আমতলা এলাকার মেয়ে লাইলী বেগম ও তার পরিবার। ৬ বছর বয়সে বাবার হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে সার্কাসে যোগ দেন তিনি । এর পর সার্কাসের ভেতরেই বেড়ে ওঠা, বিয়ে তারপর মা হয়ে এখন স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে সারা বছর সার্কাসে খেলা দেখান।
লাইলী বেগম জানান, পরিবারের চার জন মিলে গড়ে দিনে আয় করেন মাত্র এক হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে সংসার চলেনা। সার্কাস চললে আয় হয়। না চললে আধাপেটে থাকতে হয়। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করানোর কোন সুযোগ নেই। দি গ্রেট রওশন সার্কাসে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ নানা কাজের সাথে জড়িত আছেন। অনেকেই আছেন বংশানুক্রমিক পরিবার নিয়ে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর কাজির হাটের পারভেজ আলী স্ত্রী, ১৭ বছরের ছেলে ফিরুজ আর চার বছরের মেয়ে নুরে জয়নাব কে নিয়ে একবছরের চুক্তিতে খেলা দেখাচ্ছেন। পারভেজ জন্ম থেকেই সার্কাসে। তার বাবা মাও সার্কাসের শিল্পী ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, সার্কাস শিল্পীদের দুঃখ কেউ বোঝেনা। আমাদের জীবন অনিশ্চিত। আগে মালিকেরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক আনতেন। শিশু কিশোরদের পড়াশোনার জন্য শিক্ষক রাখতেন। কিন্ত এখন এই উদ্যোগ নেই। মালিকেরা কোন রকমে সার্কাস চালাচ্ছেন। সারা বছর চলেনা। মালিকদের লোকশান গুনতে হয়। যখন সার্কাস চলেনা তখন হাটে বাজারে বা স্কুল কলেজে খেলা দেখিয়ে সংসার চালান অধিকাংশ সার্কাস শিল্পী। ছলছল চোখে একই কথা জানালেন সার্কাসের জোকার চার্লি বাবুল, আবুল কাশেম ও মোহাম্মদ জিয়া।
বর্তমানে শতাব্দী প্রাচীন বাংলা লোক শিল্পের এই ধারাটি হারিয়ে যেতে বসেছে । দিগ্রেট রওশন সার্কাসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শেখ আফতাব উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, পৃষ্ঠপোষকতা, বিনিযোগ, প্রশিক্ষক আর দক্ষ শিল্পীর অভাবে বর্ণহীন হয়ে পড়েছে এই শিল্প। ফলে করুণ জীবন যাপন করছে এই শিল্পে জড়িত কলা কুশলীরা। সার্কাস চললে তাদের খাবার জোটে না চললে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়।
এদেশের সার্কাস দলে হাস্যরসাত্মক অভিনয় আর ও খেলা প্রদশর্নীতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন শারীরিকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতিক মানুষ বা বামনপীর। অসহায় শিশু ও নারীদেরকেও সার্কাস দলগুলো নির্ভরতা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে অনেকে পরিবার পরিজন নিয়েই সার্কাস দলে থাকেন। শিশুরা স্কুল না গিয়ে বাবা মায়ের কাছেই সার্কাস শিখে নেয়। পরবর্তীতে বংশ পরম্পরায় কাটিয়ে দেয় সার্কাসে।
প্রায় ৮০০ বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে সার্কাসের সূচনা হয়। তখন ঘোড়া আর ঘোড়ার সাথে জুড়ে দেয়া দু’চাকার গাড়ির দৌড়ই ছিল সার্কাসের মূল উপজীব্য।
বৃটিশ আমলে ১৯০৫ সালে ‘দি লায়ন সার্কাস’ নামে প্রথম একটি সার্কাস দল গঠিত হয় পূর্ববঙ্গে। দলটি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে নাম পরিবর্তন করে এবং ‘দি সাধনা লায়ন সার্কাস’ নাম গ্রহণ করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সালে পর্যন্ত এদেশে বেশকিছু দল প্রায় নিয়মিতভাবে সার্কাস প্রদর্শনী করতো।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদেশে বেশ কিছু সার্কাস দল গঠিত হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বগুড়া মহাস্থানগড়ের আব্দুস সাত্তারের দি বুলবুল সার্কাস, বরিশালের বীরেনচন্দ্র দাসের দি রয়েল সার্কাস, ফেনির সুনীল চন্দ্র পালের দি সবুজ বাংলা সার্কাস, সাতক্ষীরার দি সুন্দরবন সার্কাস, নারায়নগঞ্জের মুকুলের দি কাঞ্চন সার্কাস, চট্টগ্রামের আনোয়ার খানের দি কোহিনূর সার্কাস, সৈয়দপুরের আকবর শেখের দি রওশন সার্কাস, ব্রাক্ষনবাড়িয়ার এমএ সামাদের দি নিউ স্টার সার্কাস, আব্দুল বশিরের দি ন্যাশনাল সার্কাস, ঢাকা-নবাবগঞ্জের নিরঞ্জন সরকারের দি লায়ন সার্কাস, ঢাকা-বর্ধনপাড়ার রতন সরকারের দি লক্ষীনারায়ন সার্কাস, দি রাজমহল সার্কাস, শৈলেন বাবুর নিউ সবুজ বাংলা সার্কাস এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের বসন্তকুমার মোদকের দি সোনার বাংলা সার্কাস।
জানা গেছে বর্তমানে সারা দেশে ১৫ থেকে ১৬ টি সার্কাস দল কোনমতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে । আর এই দলগুলোতে শিশু নারী পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার কলাকুশলী অনিশ্চিত জীবন নিয়ে দিন পার করছেন।
শেখ আফতাবউদ্দিন ক্ষোভের সাথে বলেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এ্যক্রোবেটিক দলে সার্কাসের মূল শিল্পীদের যায়গা হয়নি। যারা অনাহারে অর্ধাহারে সার্কাসখেলা দেখিয়ে চলেছেন তাদেরকে এই দলে নিলে অনেক শিল্পীই ছেলে-মেয়ে নিয়ে একটু হলেও ভাল থাকতে পারতেন।
তিনিসহ অন্যান্য শিল্পীরা বলেন, বাংলাদেশে এখনো সার্কাস প্রশিক্ষণের জন্য ইন্সটিটিউট গড়ে না ওঠার কারণে শিশুদেরকে মা বাবার কাছে অথবা সার্কাস দলের অনভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের কাছ থেকেই খেলা শিখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেলা দেখাতে হয়। তাই তাদের দাবি একটি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা। ভাল প্রশিক্ষণ পেলে ক্রিকেটের মতোই সারা বিশ্বে সুনাম কুড়াবে বাংলাদেশের সার্কাস এমনটাই আশা তাদের।
অন্যদিকে এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকার এগিয়ে আসবেন বলে প্রত্যাশা করেন তারা। সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণে প্রদর্শনী আয়োজনে রয়েছে নানা বাঁধা বিপত্তি। শিল্পীরা জানিয়েছেন রমজান মাস আর শোকের মাস আগষ্ট বাদ দিয়ে ১০ মাস সার্কাস প্রদর্শনীর অনুমতি মিললে ভাল হয়। ইন্টারনেট এবং টেলিভিশনের দাপটেও এই সময়ে সার্কাসের প্রতি দর্শকের আগ্রহ বাড়ছে বলে মনে করেন সার্কাসের মালিক ও কলাকুশলীরা। নানা রকম শারীরিক কসরৎ, পোষা পশু পাখির খেলা আর হাস্যকৌতুকের খোঁজে এখনো দর্শক চান সার্কাস দেখতে। সার্কাস দেখতে আসা তরুণ দর্শকরা মনে করেন ঐতিহ্যবাহী এই সার্কাসকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ জরুরি।
বিডি প্রতিদিন/১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/হিমেল