বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের জীববৈচিত্র্যে সুরক্ষাসহ অরণ্যে আগুন দস্যুতা ঠেকাতে বন সন্নিহিত লোকালয় জুড়ে কাঁটা তারের বেড়া ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মান কাজ এক বছরেও শুরু হয়নি। একই সাথে সুন্দরবনের এই দুটি রেঞ্জের ভরাট হয়ে যাওয়া খালসহ মিঠা পানির মাছের খনিখ্যাত ছোট-বড় ৩৫টি বিলে একাধিক পুকুর খননের নেই কোন উদ্যোগ।
গত বছরে মাত্র এক মাসের মধ্যে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর ষ্টেশনের গহীন অরণ্য নাশকতার আগুনে পুড়ে ছাই হবার পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং তৎকালিন প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী সুন্দরবনে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরপরই এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের নিদের্শ দিলেও আজও ওইসব প্রকল্প অনুমোদন পায়নি।
সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় জরুরী এসব প্রকল্প এখনো ফাইলবন্ধী হয়ে পড়ে রয়েছে। এই আবস্থায় বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলীর মাদ্রাসার ছিলা এলাকায় গত ২৬ মে সকালে আবারও নাশকতার আগুনে পুড়ে ছাই হয় সুন্দরবন। এবার ৩ দিন ধরে আগুনে পুড়ে যায় সাড়ে ৪ একর বন।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও মংলা উপজেলার বন সন্নিহিত এলাকায় কাটা তারের বেড়াসহ ওয়াচ টাওয়ার নির্মান ও ৩৫ বিলে একাধিক পুকুর খনন প্রকল্প গত এক বছরেও অনুমোদন পায়নি। খোদ পরিবেশ ও বন মন্ত্রী এবং তৎকালিন প্রধান বন সংরক্ষকের নির্দেশিত এসব প্রকল্পের মধ্যে ছিলো, চাঁদপাই রেঞ্জের বৈদ্যমারীর লোকালয় থেকে শুরু করে কাটাকালী- বরুইতলা- জিউধরা- আমুরবুনিয়া- গুলিশাখালী- কলমতেজী ও ধানশাগর ষ্টেশন থেকে নাংলী টহল ফাড়ী পর্যন্ত ওয়াচ টাওয়ারসহ কাটাতারের বেড়া নির্মাণ। একই সাথে চাঁদপাই রেঞ্জের পরিকল্পিত ভাবে আগুন ধরিয়ে দিয়ে অবৈধ্য উপায়ে মিঠা পানির মাছ চাষ ও আহরণ চিরতরে বন্ধে ছোট-বড় ২৩টি বিলের প্রতিটিতে এক বা একাধিক পুকুর খনন। খনন করা পুকুরের মাটি দিয়ে অবশিষ্ট বিল ভরাট করে সেখানে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনায়ন করা। যাতে করে সুন্দরবনে বিলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে অবৈধ উপায়ে মিঠা পানির মাছ চাষ বন্ধ করা। একই সাথে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণীর চাহিদা মিটাবে খননকৃত ওইসব পুকুরের মিঠা পানি।
গত বছরের ২৭ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিলের পর্যন্ত মাত্র এক মাসে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর ষ্টেশনভূক্ত নাংলির পচাকোড়ালিয়া, টেংরা ও তুলাতলা বিলের মিঠা পানির মাছ আহরণ ও জাল পাতার স্থানসমুহ পরিস্কার করতে র্দুবৃত্তরা গহীন বনে চার দফায় পরিকল্পিত ভাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২০০২ সালের ২২ মার্চ ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড কটকা অভয়ারণ্যের প্রায় ১৫ দিন ধরে জ্বলতে থাকা আগুনের মধ্য দিয়ে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় বনে শুরু হয় অগ্নিকান্ডের ঘটনা। পরিকল্পিত ভাবে এসব আগুন লাগানো দুস্কর্মের সাথে জড়িত আপরাধীরা সব সময় থেকে যায় ধরাছোয়ার বাইরে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ মে চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলীর মাদ্রাসার ছিলা এলাকায় গত ২৬ মে সকালে আবারও নাশকতার আগুনে পুড়ে ছাই হয় সুন্দরবন। এবার ৩ দিন ধরে আগুনে পুড়ে যায় সাড়ে ৪ একর বন। এনিয়ে ১৫ বছরে ২৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। গত বছরে সুন্দরবনে চারদফা নাশকতার আগুনে ঘটনার পর আগুন দস্যুদের ঠেকাতে দ্রুত বন সন্নিহিত লোকালয় জুড়ে কাঁটা তারের বেড়া ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মান এবং ভরাট হয়ে যাওয়া খালসহ মিঠা পানির মাছের খনিখ্যাত ছোট-বড় ৩৫টি বিলে একাধিক পুকুর খননের ঘোষণা দেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং তৎকালিন প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী।
যেভাবে সৃষ্টি হয় সুন্দরবনে বিল :
৯০ এর দশকের শুরুতে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরনখোলা ও মোড়েলগঞ্জে উপজেলার বনসন্নিহিত লোকালয়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভোলা নদী ও শাখা খালসমুহ ভরাট হয়ে যাবার কারণে সুন্দরবন অংশে পলি পড়ে উচু হয়ে যায। একারণে চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে বন মরে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ছোট-বড় ৩৫টি বিলের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে ওইসব বিল মিঠা পানি প্রজাতীর মাছের ভান্ডারে পরিণত হয়। সুন্দরবনের বিলে বৈধ্ভাবে মিঠা পানির মাছ চাষ করে তা আহরণের কোন সুযোগ না থাকায় শাসকদলের প্রভাবশালী ৫/৬টি গ্রুপ সুন্দরবনের অসাধু কর্মকর্তাদের লাখ-লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে এসব বিল অবৈধ উপায়ে দখলে নিয়ে উচ্চ মূল্যে তা আবার মৎস্য আড়ৎদার ও জেলেদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে থাকে। আর এসব বিল পরিস্কার করে মাছ আহরণ করতেই দস্যুরা সুন্দরবনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে থাকে।
সুন্দরবনে ৩৫টি মিঠা পানির বিল :
সুন্দরবনসহ উপকূলের অপরাধ জগতের হাল নাগাদ খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র বলছে, সুন্দরবনের এসব বিলের মধ্যে শুধু চাঁদপাই রেঞ্জেই ছোট-বড় ২৩টি মিঠা পানির মাছের বিল মধ্যে নাংলী টহল ফাড়ীর পশ্চিম-উত্তর কোনে কোড়ালিয়া ও পচা কোড়ালিয়া, আমুরবুনিয়া টহল ফাড়ীর অধিন ছোট টেংরা ও বড় টেংরা, গুলিশাখালী- আমুরবুনিয়ার মঝে পয়শট্টির ছিলা ও তেশাট্টির ছিলা, আমুরবুনিয়া টহল ফাড়ীর উত্তর দিকে নিশানখালী, শ্যালা নদীর পশ্চিম পাড়ে ছোট কাকড়া ও কাকড়ামারী, শ্যালা নদীর উত্তর পাড়ে মৃগমারী নিচে তেতুলতলা, বৈদ্যমারী ক্যাম্পের পূর্ব পাশে বৈদ্যমারী পোড়ামহল, আমুরবুনিয়া টহল ফাড়ীর দক্ষিনে আমুরবুনিয়া পোড়ামহল, কাটাখালী টহল ফাড়ীর দক্ষিণ পাশে কাটাখালী, শুয়ারমারা টহল ফাড়ীর দক্ষিণ-পূর্বে মুর্তিখানা,গুলিশাখালী-ধানসাগর টহল ফাড়ীর মাঝামাঝি বাইশা ছিলা ও তেইশা ছিলা, কলমতেজী টহল ফাড়ীর উত্তর কলমতেজী, নাংলী টহল ফাড়ীর কাছে উত্তর তুলাতলা ও দক্ষিণ তুলাতলা, জোংড়ার টহল ফাড়ীর দক্ষিণ পশ্চিমে আন্ধারমানিক, নাংলী টহল ফাড়ীর পশ্চিম উত্তর দিকে বাদুরতলা, আড়ুয়াবয়া খালে ঘুকেই বাম পাশে পায়খানা বিল ও নাপিতখালী বিল। অন্য ১২টি বিল রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায়।
এসব বিলের মধ্যে অবৈধ্য উপায়ে মাছ আহরণকারীদের নাশকতার আগুনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে একমাত্র বাদুরতলা বিলটি।
বাগেরহাটের শরনখোলা ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় বন সন্নিহিত চার ইউপি চেয়ারম্যানসহ বাঘ জাকির, বাঘ মিলন, জাল মাসুম, জিয়ল সগির, ডিলার মিলন, সুমন মেম্বার, কবির তালুকদার ও শাহজাহান হাওলাদার ওরফে শাহজাহান শিকারীর মতো শাসকদলের প্রভাবশালীরা এক শ্রেণির অসাধু বন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে কথিত ইজারার নামে পূর্ব সুন্দরবনের চাদঁপাই ও শরণখোরা রেঞ্জের ৩৫টি বিলের কৈ, শিং, মাগুর, কানমাগুর, ফলইসহ বিভিন্ন প্রজাতি মিঠা পানির মাছ চাষ ও আহরণ করে থাকে। এজন্য শুকনা মৌসুমে মাছের বিল ও জাল পাতার স্থান পরিস্কার করতে পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে থাকে।
বিডি প্রতিদিন/১১ জুন ২০১৭/হিমেল