মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার দায় দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অংসান সু চি এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসা তিন নোবেলজয়ী।
সোমবার বিকেল ৪টায় উখিয়ার থাইংখালী তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান,উত্তর আয়ারল্যান্ডের নোবেল বিজয়ী মেরেইড ম্যাগুয়ার ও ইরানের নোবেল বিজয়ী শিরীন ইবাদি এ কথা বলেন।
আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে তারা বলেন, মিয়ানমারের যে গণহত্যা, জাতিগত নিধন, গণ ধর্ষণ ও শিশু হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে তা মেনে নেওয়া যায়না। এ মুহুর্তে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিন নোবেল বিজয়ী আর্ন্তজাতিক হস্তক্ষেপ কামনা করে মুসলিম বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিংকালে ইরানের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শিরীন ইবাদি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতিত,নিপীড়িত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ আজ বাংলাদেশে এসে পরবাসে জীবন-যাপন করছে। এসব সর্বশান্ত রোহিঙ্গাদের জন্য অমুসলিম রাষ্ট্র গুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আর্ন্তজাতিক বিশে্বর হস্তক্ষেপ দাবী করছেন, সেখানে মুসলিম দেশগুলোর চুপ মেরে থাকার বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বিস্মিত হওয়ার কথা। তিনি এ মুহুর্তে সমগ্র মুসলিম জাতিসত্তাকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখার আহবান করেন।
এসময় ইয়েমেনের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তাওয়াক্কুল কারমান চোঁখের জল ফেলে বলেন, রোহিঙ্গাদের নিযার্তনের কথা আমরা শুনে আসছিলাম। আজ বাস্তবে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের হৃদয় বিদারক নির্যাতনের বর্ণনা শুনে একজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে আমি চোঁখের পানি ধরে রাখতে পারছিনা। তিনি রোহিঙ্গা নারী,পুরুষ শিশুদের উপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে এর বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। অং সান সুচি’র পদত্যাগ করা উচিত। যেহেতু শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন নারী। পাশপাশি তিনি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে এর দায়ভার এড়াতে পারেনা।
উত্তর আয়ারল্যান্ডের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মেরেইড ম্যাগুয়ার বলেন, মিয়ানমারের সেনা, পুলিশ ও রাখাইনদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে এদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সেবা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে হৃদয় দেখিয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ জন্য নোবেল বিজয়ী নিজে এবং তার দেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে স্ব সম্মানে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে মিয়ানমারকে। এ জন্য তিনি আর্ন্তজাতিক বিশ্ব তথা সমগ্র জাতিকে মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করার উদাত্ত আহবান জানিয়ে আরো বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের যে ভাবে ধর্ষণ, উৎপীড়ন ও নির্যাতন করা হয়েছে এ জন্য অং সান সুচি ও তার সরকারের বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত।
এর আগে দুপুর ২টার দিকে তিন দেশের তিন নোবেল বিজয়ী উখিয়ার থাইংখালী তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে পৌঁছালে, সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও সংস্থা সংশ্লিষ্টরা তাদের স্বাগত জানান। পরে নোবেল বিজয়ীরা ওই ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে ক্যাম্পে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় করেন। এসময় ক্যাম্পের সার্বিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান এবং রোহিঙ্গাদের জীবন যাপনের খোঁজ খবর নেন নোবেল বিজয়ীরা।
উপস্থিত ডেপুটি সেক্রেটারী মোহাম্মদ শাহীন নোবেল বিজয়ীদের উদ্দেশ্যে জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের পাশাপাাশি সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এরপরে তিন নোবেল বিজয়ী সরাসরি তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের ভিতরে যেখানে রয়েছে ধর্ষিতা,গুলিবিদ্ধ সহ অসংখ্য নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী,পুরুষ,শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণীর রোহিঙ্গা।
সেখানে নোবেল বিজয়ীরা একটি কক্ষে অপেক্ষমান মিয়ানমারের রাশিদং এর ছেয়াপ্রাং গ্রামের স্বামীহারা রোহিঙ্গা নারী ছুফাইয়া বেগম(২০) সন্তানহারা নুর জাহান(২৮) সাবেকুন নাহার (৩০) মিয়ানমার সেনা কর্তৃক ধর্ষিত ফাতেমা খাতুন (২৫) রাজেয়া বেগম (২৩) ছেহেরু খাতুনের (২৪)মূখ থেকে মিয়ানমার সেনা,পুলিশ ও রাখাইন যুবকদের পাষবিক নির্যাতনের দীর্ঘক্ষণ বর্ণনা শুনে নোবেল বিজয়ীরা বেরিয়ে আসেন।
এসময় সাংবাদিকেরা ওই রোহিঙ্গা নারীদের সাথে কথা বললে তারা জানান, নোবেল বিজয়ীরা তাদেরকে কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা জানতে চেয়েছে। মহিলাদের টিম লিডার সাবেকুন নাহার জানান, গত বছরের ২৭ আগষ্ট মিয়ানমার সেনারা বাড়ীতে হামলা চালিয়ে তার ২সন্তান, শ্বশুর, দেবরসহ একই পরিবারের ৫জনকে চোঁখের সামনে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার শোনার পর নোবেল বিজয়ীরা তাদের সামনে চোঁখের জল ফেলেছেন এবং বলেছে মিয়ানমার সরকারকে একদিন বিচারের কাঠ গড়ায় দাঁড়াতে হবে। নোবেল বিজয়ীরা গুলিবৃদ্ধ, হাত-পা কাটা, চোঁখ উপড়ে ফেলা, স্বামী-সন্তান,স্ত্রী-পুত্র হারাসহ ক্ষত বিক্ষত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী পুরুষের সাথে কথা বলেন।
বিডিপ্রতিদিন/ ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮/ ই জাহান