২৩ আগস্ট, ২০১৯ ১৯:৫৯

যোগ্য পিতার দায়িত্ব পালন করলেন মেয়র

নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া:

যোগ্য পিতার দায়িত্ব পালন করলেন মেয়র

চার পাড়া নিয়ে সুলতানপুর মহল্লা। সেই গ্রামজুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। সেই উৎসবের কারণ একটি বিয়ে। এলাকাবাসীর মুখে মুখে রটে গেছে সেই বিয়ের কথা। আয়োজনও ব্যাপক। গরু জবাই করা হয়েছে বরযাত্রী আর নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানোর জন্য। পাড়াজুড়ে করা হয়েছে আলোকসজ্জা, পাড়ার দুই মাথায় দুটি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে নিমন্ত্রিতদের স্বাগত জানানোর জন্য। 

বর্ণাঢ্য এই বিয়ের আয়োজন যার জন্য, তিনি সুলতানপুর মহল্লার বাবা-মা হারা এক মেয়ে। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন স্থানীয় কলেজ থেকে। এতিম এই মেয়ের বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজক বগুড়ার শিবগঞ্জ পৌর মেয়র। এ কারণে অনেকের মুখেই রটে গেছে যে মেয়রের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে যেন আগ্রহ আরও বেশি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাজিয়া সুলতানা (১৯) নামে যে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক ২০১৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারও দুই বছর আগে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে সংসার ছেড়ে চলে যান রাজিয়ার মা গোলাপী বেগম। সেই দুই ছেলের মধ্যে বড়টি আবার শারীরিক প্রতিবন্ধী। ফলে চরম অন্ধকার নেমে আসে রাজিয়ার পরিবারে। রাজিয়াই তার পরিবারের বড় মেয়ে। যখন বাবা মারা যায় তখন সবেমাত্র নবম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে সে। পরিবারের হাল ধরার যেমন কেউ নেই, তেমনি এতিম এই তিন সন্তানকে প্রতিপালন করারও সামর্থ নেই তার চাচাদের। রাজ্জাকের জানাযার নামাজে অংশ নিতে গিয়ে বিষয়টি জানার পর শিবগঞ্জ পৌর মেয়র এই পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দেন। 

কিছুদিন পরেই রাজিয়ার ছোটভাই সিয়ামকে ভর্তি করে দেন একটি আবাসিক হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। আর প্রতিবন্ধী ছেলে মোহসীন আলীর নামে ভাতার ব্যবস্থা করেন। অনেকের ধারণা ছিলো এটা করেই হয়তো দায়িত্ব শেষ করবেন মেয়র। কিন্তু তা করেননি। রাজিয়ার লেখাপড়ার সমস্ত খরচই বহন করেছেন তিনি। এসএসসি পাশ করার পর তাকে ভর্তি করে দেন শিবগঞ্জ সরকারি এমএইচ মহাবিদ্যালয়ে। এবার সেখান থেকেই এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে রাজিয়া। এরই মাঝে মেয়েটির পাত্র খুঁজতে শুরু করেন। এতিম মেয়েকে বিয়ে করবে এমন পাত্র পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি। একই সুলতারপুর নয়াপাড়ার বাসিন্দা আজাদুল ইসলাম (২২) এই বিয়েতে সম্মত হন। পেশায় নিমার্ণ কাজের হেড মিস্ত্রি আজাদুলকে দেখে পছন্দ করে মেয়েও। ফলে সেখানেই বিয়ের আয়োজন করা হয়।

বিয়ের কথা পাকাপাকি হওয়ার পরই আজাদুলের বাড়ির ঘর-দরজা ও শৌচাগার নির্মাণ করে দেন মেয়র। এরপর চলে বিয়ের আয়োজন। বর-কনের জন্য দুই ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার থেকে শুরু করে খাট, ফ্রিজ, শোকেস, ডাইনিং টেবিলসহ যাবতীয় আসবাবপত্র কেনার উদ্যোগ নেন তিনি। এতিম মেয়ের বিয়ের খবরে এলাকার হিতৈষী ব্যক্তিরাও এগিয়ে আসেন। তারাও নানা উপহার সামগ্রী কিনে দেন বিয়েতে। আর পুরো বিয়েকে স্মরণীয় করতে পাড়াজুড়ে করা হয় আলোকসজ্জা। নৃত্য-গীতের জন্য শহর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় গায়েন। মহল্লার নারী-পুরুষ বিয়ের আগের রাতে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। তাদের জন্য রাতে ২২ কেজি চাউলের আটার মুঠা তৈরী করা হয়।

এই বিয়ের আয়োজনে বর-কনে দু’জনই বেশ উৎফুল্ল। কনে রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘বাবা-মা যে নেই, সেটা বুঝতেই পারছি না। তারা থাকলেও হয়তো এতো ভালো আয়োজন করতে পারতো না।’ তিনি নতুন সংসারের জন্য সকলের দোয়া চান।

বর আজাদুল ইসলাম বলেন, ‘কনে পাশের পাড়ার হওয়ায় তার সম্পর্কে আগে থেকেই সবই জানতাম। এমন একটি মেয়েকেই বিয়ের ইচ্ছা ছিলো যার কেউ নেই। এরই মাঝে মেয়র সাহেবের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে আমার পরিবারও রাজি হয়। আমাদের বিয়েতে যে এতো আয়োজন হবে তা ভাবতেই পারিনি।’

পৌর মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিক জানান, বিয়েতে চার পাড়ার সকল পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানোর পাশাপাশি পৌর এলাকার অনেককেই নিমন্ত্রণ করা হয়। বিয়েতে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর কবির, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাজ্জাকুল ইসলাম রাজুসহ অনেকেই এসে নবদম্পতিকে আশির্বাদ করে গেছেন। 

তিনি বলেন, ‘আমার নিজের একটি ছেলে ছাড়া কোন মেয়ে নেই। যেহেতু রাজিয়ার বাবা-মা কেউ নেই, একারণে আমিই তার অভিবাবকত্ব করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীও তাকে মেয়ের মতোই মনে করতো। একারণে আমরা বিয়েটিকে মোটামুটি উৎসবমুখর করার চেষ্টা করেছি। উদ্দেশ্য একটিই যেন ওর (রাজিয়া) মনে না হয় বাবা-মা নেই বলে তার বিয়েটা সাদামাটা হয়েছে।’

বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর