বগুড়ার সান্তাহার-বোনারপাড়া রেলপথে ৪৬টি ছোট বড় সেতুর মধ্যে দুটি সেতু মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেতু দুটি হচ্ছে বগুড়া শহর লাগোয়া করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত চেলোপাড়ায় সেতু (এফ ২৫) ও সোনাতলা উপজেলার ভেলুরপাড়া ও সৈয়দ আহম্মদ কলেজ স্টেশনের মাঝামাঝি বাঙ্গালী নদীর ওপর নির্মিত মধ্য দিঘলকান্দী চকচকিয়া সেতু (এফ-৪৫)। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সেতু দুটির মেয়াদ অনেক আগে শেষ হয়ে গেলেও নতুন করে তৈরির কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চুন আর সুরকির মিশ্রণযুক্ত ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত সেতুগুলোর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ৬০ বছর ধরা হলেও এগুলোর বয়স এখন প্রায় ১২০ বছর পেরিয়ে গেছে। এতে করে প্রতিনিয়তই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন এবং হাজারো যাত্রী।
খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তারাই বলছেন, সেতু দুটির গার্ডার দুর্বল হয়ে পড়েছে কিন্তু তার পরেও সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে না। কেবলমাত্র যখন পিলারের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার মত ভয়াবহ ঘটনা জনগণের চোখে পড়ছে কেবল তখনই সেতুগুলো মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বগুড়ায় ট্রেনের নিয়মিত যাত্রীরা বলছেন, একশ’ বছরের বেশি আগে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত সেতুগুলোর বেশিরভাগই যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে তা বাইরে থেকে খোলা চোখে দেখলেই অনুমান করা যায়। ট্রেনগুলো বিশেষত দ্রুতগামী আন্তঃনগর ট্রেন যখন ছুটে চলে তখন সেতুগুলো যেন কাঁপতে থাকে। যে কোনো সময় মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সময় আর নির্দিষ্ট কিছু গন্তব্যে যাতায়াতের জন্য ট্রেনের বিকল্প কোনো যানবাহন না থাকায় বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের চলাচল করতে হচ্ছে।
বগুড়া রেলওয়ে প্রকৌশল শাখার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলে ১৮৯২ সালে রেললাইন স্থাপন শুরু হয়। এরমধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের অধীন লালমনিরহাট বিভাগের আওতায় বগুড়ার সান্তাহার থেকে বোনারপাড়া পর্যন্ত ৬টি উপজেলা যেমন সোনাতলা, গাবতলী, বগুড়া সদর, কাহালু, দুপচাঁচিয়া ও আদমদীঘি উপজেলায় মোট সাড়ে ৭১ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৬টি সেতু রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শত বছরের প্রাচীন সেতুগুলো ট্রেন চলাচলের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ আগে চুনের সঙ্গে সুরকি মিশিয়ে ইট গেঁথে তার ওপর লোহার গার্ডার যুক্ত করে সেতুগুলো নির্মাণ করা হয়। যার মধ্যে দুটি সেতু মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে। মাঝে মাঝেই সেতুগুলোর পিলার দেবে যাচ্ছে নয়তো গার্ডার দুর্বল হয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
সর্বশেষ গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সকালে বগুড়ার সুখানপুকুর ও ভেলুরপাড়া রেলস্টেশনের মাঝে চকচকিয়া সেতুর একটি পিলার দেবে যায়। সেতুটি মেরামতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। ওই সময় পর্যন্ত ট্রেন চলাচলও বন্ধ রাখতে হয়। একইভাবে এর আগে গাইবান্ধা জেলার মহিমাগঞ্জে বাঙালি নদীর ওপর একটি রেলসেতুম মেরামত ও সংস্কার করতে হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গার্ডার দুর্বল হয়ে পড়েছে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব দিকে করতোয়া নদীর ওপর শত বছর আগে নির্মিত রেল সেতুরও।
বগুড়ার সোনাতলা স্টেশন মাস্টার আবদুল হামিদ জানান, দীর্ঘ এই রেলপথে আন্ত:নগর, মেইল ও লোকাল মিলে ১৬টি ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ঢাকা- লালমনিরহাটগামী লালমনি এক্সপ্রেস, ঢাকা-রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস, সান্তাহার থেকে দিনাজপুরগামী দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস, সান্তাহার থেকে লালমনিরহাটগামী করতোয়া এক্সপ্রেসসহ চার জোড়া আন্ত:নগর ট্রেন চলাচল করে এ রুটে।
তিনি বলেন, এই রুট দিয়ে উত্তরবঙ্গের লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও বগুড়াসহ ৫টি জেলার মানুষ ট্রেনে করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে থাকেন।
জেলার সোনাতলা-বগুড়া রুটে নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াতকারী সোনাতলা উপজেলা পরিষদের কর্মচারী আবু রায়হান জানান, ২৯ কিলোমিটার রেলপথে একাধিক রেলসেতু রয়েছে। এর মধ্যে বগুড়া স্টেশনের কাছাকাছি করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত সেতুর ওপর যখন ট্রেন ওঠে তখন মনে হয় পুরো সেতুটি যেন কাঁপতে থাকে। প্রচণ্ড ভয়ও লাগে তখন।
তিনি বলেন, সোনাতলা থেকে বগুড়ায় সড়কপথে যানবাহন থাকলেও সময় যেমন বেশি লাগে তেমনি ভাড়াও কয়েকগুণ বেশি গুণতে হয়। যে কারণে জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও ট্রেনে চলাচল করতে হয়।
ঢাকা-লালমনিরহাটগামী লালমনি এক্সপ্রেসের চালক মিঠু মিয়া জানান, সেতুর অবস্থা যাই হোক না কেন তাদের ট্রেনের গতি কমানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমাদেরকে যে গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তার কম বা বেশি করার কোনো সুযোগ নেই। নিয়ম মেনেই আমাদের ট্রেন চালাতে হয়।
রেলওয়ের বগুড়ার সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আবু মাসুদ জানান, বগুড়ার সান্তাহার-বোনারপাড়া রুটে প্রায় ৭২ কিলোমিটার রেলপথে ছোট বড় ৪৬টি রেলসেতু আছে। এর মধ্যে বগুড়ার করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত চেলোপাড়া সেতুর পশ্চিমপাশের গার্ডারটি খুবই নাজুক আবস্থায় আছে। কারণ ফতেহ আলী এবং রাজাবাজারে সমস্ত নোংরা বর্জ্য ওই সেতুর কাছে ফেলা হয়। এতে করে দীর্ঘদিনের নির্মিত গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া পথচারিরা সেতুর নিচ দিয়ে যে স্লিপার দিয়ে চলাচল করে সেটি চলার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। চকচকিয়া সেতুটির একটি গার্ডার আরসিসি করা হলেও অন্য তিনটি এখনও ঝুঁকির মধ্যেই রয়েই গেছে। এরই মধ্যে ঊর্ধর্তন কর্মকর্তারা সেতুটি পরিদর্শনও করেছেন। সেতুর দুটির বর্তমান অবস্থা জানিয়ে রেলের প্রধান প্রকৌশলী মহোদয়ের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। দিক নির্দেশনা এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা