৮ জুন, ২০২১ ১৮:১০
নদী ভাঙন

মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চৌহালী উপজেলা!

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে চৌহালী উপজেলা!

যমুনা নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ফসলি জমি।

উপজেলা পরিষদ ভবন, থানা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ব্যাংক-বীমা অফিস ৯ বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ধীরে ধীর বিলীন হয়েছে কয়েক শতাধিক গ্রাম, পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্টসহ নানা স্থাপনা। বর্তমানেও ভাঙন অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে বসতভিটা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ফসলি জমি।

করালগ্রাসী যমুনা নদীর ভাঙনে চৌহালী উপজেলা সিরাজগঞ্জের মানচিত্র থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে এক সময় চৌহালী উপজেলা শুধু কাগজে-কলমে থাকবে কিন্তু বাস্তবে তা নদীগর্ভে হারিয়ে যাবে।

জানা যায়, যমুনা নদীর দুপাড়ে সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে চৌহালী উপজেলা গঠিত। এর মধ্যে পশ্চিমপাড় একটি ইউনিয়ন সদিয়াচাঁদপুর ও মধ্য যমুনায় স্থল ও উমারপুর ইউনিয়ন এবং পূর্বপাড়ে চারটি ইউনিয়ন। আয়তন ৮০ বর্গমাইল। মধ্য যমুনায় স্থল ও উমারপুর ইউনিয়নের মানুষের জীবন ভাঙা-গড়ার খেলায় চলছে।

বিগত ১২ বছরের মধ্যে পূর্বপাড়ের চারটি ইউনিয়নের অধিকাংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। খাসকাউলিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত উপজেলা পরিষদ ভবন, আবাসিক কোয়ার্টার, থানা ভবন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সোনালী ব্যাংক, কৃষি অফিসসহ সবকিছু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে রুম ভাড়া নিয়ে এসব অফিসের কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে পূর্বপাড়ের চারটি ইউনিয়নেই ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিন ভাঙনে একটু একটু করে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

বসতবাড়ির জায়গা না থাকায় হাজার হাজার পরিবার পার্শ্ববর্তী জেলা টাঙ্গাইলের বিভিন্ন উপজেলায় বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন। ভোটাধিকার চৌহালী থাকলেও বসতবাড়ি অন্য উপজেলায় গড়ে তোলা হয়েছে। নামে চৌহালী উপজেলার সংখ্যা ২ লক্ষাধিক থাকলেও বাস্তবে এর অর্ধেকেরও চৌহালী উপজেলায় বসবাস নেই। নদী ভাঙনের কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম চরম ব্যাহত হয়েছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাঙনের কবলে পড়ায় অঙ্কুরেই অনেক শিশুর শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে গেছে। শিশুরা এখন চরের ক্ষেত-খামার ও মাছ ধরার কাজ করছে। নদী ভাঙনের কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। গাছপালা বিলীন হয়ে গেছে। মানুষ ওয়াপদা বাঁধে ঝুপড়ি তুলে রোগ-শোক মাথায় নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো দিনমজুরের কাজ করে জীবন চালাচ্ছে। দুঃখ-কষ্ট তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট না থাকায় চলাচলেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এতো কষ্টের মাঝেও যেটুকু জায়গা এখনো রয়েছে সে জায়গা আকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তারা।

কিন্তু প্রতিনিয়ত যমুনা ভাঙার কারণে তাও ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন যাবত জেলার চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া, খাষপুখুরিয়া ইউনিয়নের রেহাইপুখুরিয়া, চরনাকালিয়া, চরবিনানই, চরসলিমাবাদ, মিটুয়ানি, খাষপুখুরিয়া গ্রামে তীব্র নদী ভাঙন চলছে। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি ফসলি জমি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে সরিয়ে নিচ্ছে। জায়গা না থাকায় ভাঙন কবলিত মানুষ অনেকে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃশ্ব এসব মানুষ ছেলেমেয়ে নিয়ে একবেলা খেয়ে আরেক বেলা না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে মিটুয়ানি হাইস্কুল, প্রাইমারি, বাজার, মসজিদ ও হাজার হাজার বসতভিটা।

স্থানীয় বাসিন্দা সালমা মাস্টার জানান, নদী ভাঙনে ইতিমধ্যে চৌহালীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যেটুকু বাকি রয়েছে তা যদি ভেঙে যায়, তবে চৌহালী উপজেলা শুধু মানচিত্রেই থাকবে। বাস্তবে তা নদীগর্ভে হারিয়ে যাবে। চৌহালীর বাসিন্দার প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন অন্য উপজেলায় বসবাস করছেন।

বাঘুটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কাহ্হার সিদ্দিকী জানান, দ্রুত যদি ভাঙন রোধে কাজ না করা হয়, তাহলে বর্ষা মৌসুমেই বাঘুটিয়া ইউনিয়নের যেটুকু অংশ রয়েছে, তার সবটুকুই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তখন কাগজে-কলমে বাঘুটিয়া ইউনিয়ন থাকবে, বাস্তবে নয়।

চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফসানা ইয়াসমিন আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, প্রতি বছর ১২-১২টি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বসতভিটা, ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ভাঙতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হবে, তা বলা যাচ্ছে না। ভাঙনরোধের জন্য প্রতি বছর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে।

চৌহালীর নদী ভাঙনে দায়িত্বে থাকা টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম জানান, ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প জমা দেওয়া আছে। যদি পাস হয় তবে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে, তবে এটা লং প্রসেস। বর্তমানে যেসব এলাকায় বেশি ভাঙন শুরু হয়, তা পরিদর্শনের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হয়। বর্তমানে বেশ কয়েকটি জায়গায় অস্থায়ী কাজ চলমান রয়েছে।

বিডি প্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর