ভাসুবিহার। অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে গুরুত্ব হারাচ্ছে প্রাচীন এ পুরাকীর্তি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। ফলে চীন, জাপানসহ অন্যান্য বৌদ্ধধর্মের দেশগুলো হতে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে চার মাইল উত্তর পশ্চিমে এবং বিহার বৌদ্ধ স্তুপ থেকে এক মাইল উত্তরে ভাসুবিহার বা বিশ্ববিহার অবস্থিত। ভাসুবিহার স্থানীয়দের কাছে নরপতির ধাপ নামে পরিচিত। সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে ৬৩৮ সালে চীনা পরিরাজক হিউয়েন সাং এই বিহার পরিদর্শনে আসেন। তিনি বিহারে তিন মাস অবস্থান করেন বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
ভাসুবিহারে একটি সুউচ্চ দুই তলা, তিন তলা অথবা চার তলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এখানে সাত শতাধিক বৌদ্ধ পন্ডিত আবাসিক হোস্টেলে অবস্থান করে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯-৮০ সালে ভাসুবিহার পরিদর্শন করেন। তিনি এই বিহারকে হিউয়েন সাং বর্ণিত স্থান হিসেবে চূড়ান্তভাবে শনাক্ত করেন। এগারো শতকে শৈবধর্মীদের উত্থানের ফলে বৌদ্ধদের প্রতি তাদের ঘৃণা, অবজ্ঞা ও শত্রুতায় বৌদ্ধরা ধর্মহীন সমাজে পরিণত হয়। ফলে ভাসুবিহারের চার তলা প্রাসাদটি পরিত্যক্ত হয়। দুর্বল পাল রাজাদের অনেকে রাজত্ব ছেড়ে শেষ জীবনে এখানে সেবক হিসেবে বসবাস করতে থাকেন। সে জন্য এই বিহারের নাম হয় নরপতির ধাপ।
সময়ের করাল গ্রাসে পাল বংশ বিনাশপ্রাপ্ত হলে পতিত অবস্থায় বিহারটি ধীরে ধীরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে এই ধ্বংসপ্রাপ্ত বিহারটি প্রথম বারের মতো খনন করা হয়। খননের পর এখানে দশ শতকের দুটি আয়তাকার প্রাসাদ দেবালয়ের ভিত্তিমূল ও দুটি মন্দিরের ভিত্তিমূল আবিষ্কৃত হয়। বিভিন্ন সময়ে ভাসুবিহার ধাপ খনন করে এখানে সাত শতাধিক প্রত্ননিদর্শন পাওয়া যায়। প্রায় ৩৭ একর জমির ওপর ভাসুবিহার বর্তমানে অরক্ষিত রয়েছে।
প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের পরিদর্শনকৃত বগুড়ার ভাসুবিহার আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাসুবিহার নির্জন ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় দেশের অন্যান্য পর্যটন স্পটের মতো এর তেমন পরিচিতি নেই। স্থাপনাটির পরিচিতি বাড়লে চীন, জাপানসহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অন্যান্য দেশের অনেক পর্যটক বাংলাদেশে আসবেন বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
ভাসুবিহারের চারপাশে এখনো কোন বাউন্ডারি ওয়াল নির্মিত হয়নি। ফলে এটি সবসময় অনিরাপদ থাকে। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরাও অনিরাপত্তায় ভোগেন। শুধুমাত্র কাঁচা ঘাসের উপর বসা ছাড়া এখানে বসার কোন আলাদা ব্যবস্থা বা বেঞ্চ নেই। ফলে পর্যটকেদের সবসময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অথবা কাঁদা ঘাসের উপর বসতে হয়। এর কোথাও কোন যাত্রীছাউনি নেই। ফলে বৃষ্টির সময় পর্যটকদের বৃষ্টির পানিতে ভিজতে হয়। ভাসুবিহারে কোন শৌচাগারও নির্মিত হয়নি।
ভাসুবিহারের চারপাশে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ, বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সৌন্দর্য বর্ধন, পিকনিক শেড, রেস্ট হাউজ, শৌচাগার ও পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হলে এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন বেড়ে যাবে।সেই সঙ্গে টিকিট ব্যবস্থা চালু করা হলে সরকারের রাজস্ব আহরণের সুযোগও সৃষ্টি হবে বলে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
ভাসুবিহারের বর্তমান দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা এনামুল হক জানান, অবহেলিত এই ধাপটি দেখতে এখনো দিনে প্রায় ১ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী আসেন। ভাসুবিহারের দুই মাইল পশ্চিমে রয়েছে শ্রংসান দীঘি। ৩০০ বিঘা আয়তনের বৃক্ষ শোভিত, ছায়া ঘেরা দীঘিটির দৃশ্যও অপরূপ। এলাকাবাসীর দাবি, ভাসুবিহারের সঙ্গে ঐ দীঘির সংযোগ সড়ক তৈরি করা হলে বেড়াতে আসা পর্যটকরা সহজেই ঐ দীঘির পাড়ও ঘুরতে পারবে। ফলে পর্যটন স্পট হিসেবে ভাসুবিহারের গুরুত্ব আরো বেড়ে যাবে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির যৌথ আয়োজনে ২০১৯ সালে ভাসুবিহারে দুই দিনব্যাপী দেশের বৃহৎ ‘প্রত্ননাটক’ মঞ্চস্থ হয়। ঐ অনুষ্ঠানে সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ মাধ্যমে প্রত্ননাটক দেশে-বিদেশে প্রচার পাওয়ায় ভাসুবিহার অনেকটা পরিচিতি পায়। অবহেলিত ভাসুবিহারে অবকাঠামো উন্নয়ন ও পর্যটকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা গেলে দেশে-বিদেশে অন্যতম পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভাসুবিহার খুবই অবহেলিত। পর্যটনের জন্য অপার সম্ভাবনাময় ভাসুবিহারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে এটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা বলেন, সীমিত বাজেটের কারণে রুটিন মেরামত ছাড়া বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
বগুড়া জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক জানান, পর্যটন এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাসুবিহারের আলাদাভাবে উন্নয়নে জেলা প্রশাসনের কোনো সুযোগ নেই। তবে আমি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি জানাব।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ