বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা জেলেপল্লীতে সোমবার (৪ নভেম্বর) থেকে শুরু হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম। বঙ্গোপসাগর সাগরতীর দুবলার বন বিভাগের বিশেষ টহল ফাঁড়ির অধীনে চারটি চরে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত চলবে শুঁটকি উৎপাদন। এবছর সাড়ে সাত কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শুরু হচ্ছে পাঁচ মাসের এই মহা কর্মযজ্ঞ।
আজ রবিবার (৩ নভেম্বর) থেকে সুন্দরবন বিভাগের অনুমতিপত্র (পাস) নিয়ে জেলে-বহদ্দাররা নৌপথে যাত্রা শুরু করেছেন নির্ধারিত চরে অস্থায়ী শুঁটকি পল্লীর উদ্দেশ্যে। তবে, প্রথমবার শুঁটকি প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত জেলেদেরক আইডি কার্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বনবিভাগ। শুঁটকি পল্লীতে অবস্থানকারীদের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া, শিশু শ্রম বন্ধসহ বনের অভ্যন্তরে যাতে কেউ অপরাধ করে পার না পায় সেকারণেই এবছর আইডি কার্ড দেয় হচ্ছে। মৌসুমের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আইডি কার্ড প্রদান শুরু করা হবে। এই আইডি কার্ডে দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি ও সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষর থাকবে। আইডি কার্ড না থাকায় গত বছরে জেলেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। যে যার মতো কাজ ও চলাচল করেছে। কে শিশু আর কে বয়স্ক তাও বোঝা যায়নি। অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছে। এখন কার্ডের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
সুন্দরবন বিভাগ জানায়, সুন্দরবনে শুঁটকি উৎপাদনকারী চরগুলোতে এবছর জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য ৯৮৫টি ঘর, ৫৭টি ডিপো ও ৯৩টি দোকান ঘর স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। গত মৌসুমের চেয়ে এবার কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে জেলে, বহদার ও দোকানের সংখ্যা। এই মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদনের লাইসেন্সধারী ১৭ জন বহদ্দার বা মহাজনের অধীনে দুবলার আলোরকোল, মাঝের কিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালারা চরসহ চারটি চরে অন্তত ১০ হাজারেরও বেশি জেলে ও শ্রমিক অবস্থান করবে। তারা পাঁচ মাস ধরে সাগরে মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণে নিয়োজিত থাকবে এই চরগুলোতে।
সুন্দরবনের দুবলা ফিশারমেন গ্রুপ ও একাধিক মহাজন সূত্রে জানা গেছে, নানা সংকট ও ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের তীরের দুর্গম এই চরগুলোতে শুঁটকি উৎপাদন করতে হয় জেলেদের। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিরাপদ খাবার পানি সংকট এবং হাজার হাজার জেলের জন্য সরকারিভাবে চিকিৎসাসেবার কোনো ব্যবস্থা না থাকা। ফলে পানিবাহিত নানান রোগ ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যথাযথ চিকিৎসার অভাবে প্রতিবছর অনেক জেলে ও শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এছাড়া, সাগরতীরের এই চরগুলোতে পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় প্রতিবছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসেও অনেকের মৃত্যু হয়।
সুন্দবনের মাঝের কিল্লার অস্থায়ী শুঁটকি পল্লীর অন্যতম ব্যবসায়ী চট্টগ্রমের মো. জাহিদ বহদ্দার ও খুলনার ফরিদ আহমেদ জানান, চরগুলোতে বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা খাবার পানি ও চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকা।
দুবলা ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, সুন্দরবনের শুঁটকি পল্লীতে আসতে ইতিমধ্যে জেলে মহানজনরা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে রবিবার মধ্যরাত থেকে তারা চরে যাওয়া শুরু করবে। বনবিভাগ এবছর জেলেদের আইডি কার্ড দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে ১০ কার্ড ছাপানো হয়েছে। কার্ডে সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তা ও ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতির যৌথ স্বাক্ষর থাকবে। কার্ডে জেলেদের সঠিক পরিচয় জানা যাবে। কোনো জেলে ছুটি নিয়ে যখন তার বাড়িতে যায়, তখন তাদের পথে পথে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। তাদের কাছে বনবিভাগের এই আইডি কার্ড থাকলে হয়রানি থেকে মুক্তি পাবে। চরগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার পানি ও সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। আলোরকোলে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) গতবছর একটি পানির প্লান্ট নির্মিাণ করেছে। তা থেকে যে পরিমাণ পানি সরবরাহ করা হয় তা জেলেদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। ফলে বালুর চরে কূপ খনন করে তাতে যে পানি জমে তা দিয়েই পিপাসা মেটায় জেলেরা। আর জেলেরা স্বাভাবিক অসুস্থ হলে মৌসুমি ওষুধের দোকানের পল্লী চিকিৎসকই তাদের একমাত্র ভরসা। বড় ধরণের কিছু হলে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। এভাবে প্রতিবছর বহু জেলের মৃত্যু হয় বিভিন্ন চরে। তাই শুঁটকি মৌসুমে চরগুলোতে পর্যাপ্ত খাবার পানি সরবরাহ ও অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানান এই মৎস্যজীবী নেতা।
সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলা বিশেষ টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরেস্ট রেঞ্জার মো. খলিলুর রহমান জানা, শুঁটকি খাত থেকে এ মৌসুমে সাড়ে সাত কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে গত বছর আয় হয়েছিল সাত কোটি ২৩ লাখ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সোমবার থেকেই চরে ঘর তোলা এবং একই সাথে সাগরে মৎস্য আহরণ শুরু করবে জেলেরা। ঘর তোলার যাবতীয় মালামাল জেলে, মহানজন-বহদ্দাররা তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে নিয়ে আসবেন। বনের কোনো সম্পদ ব্যবহার করতে পারবেন না। এবছর আইডি কার্ড থাকায় জেলেদের সঠিক সংখ্যার পাশাপাশি কোন মহাজনের জেলে তা জানা সহজ হবে। এই আইডি কার্ডে প্রত্যেক জেলের ছবি, জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্য, মহাজন-বহদ্দারের নাম এবং ঘরের নম্বর সংযুক্ত থাকবে। ফলে, কোনো জেলে বন বা অন্য কোনো অপরাধে জড়িত হলে অথবা কোনো কারণে মৃত্যু হলে আইডি কার্ডের মাধ্যমে সেই জেলেকে সনাক্ত করা যাবে। কার্ডের মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা এবং শিশু শ্রমও কমে আসবে। খাবার পানি সংকট, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।
বিডি প্রতিদিন/জামশেদ