গড়াই নদীর তীরে গাছপালা আর শিশুর হাসিতে মুখর এক টুকরো স্বপ্নলোক। রং-তুলি হাতে শতাধিক শিশু আঁকছে প্রকৃতি, নৌকা, মেঘ আর নদীর গল্প। কেউ দোলনায়, কেউ বইয়ে ডুবে—সব মিলিয়ে যেন আনন্দের রাজ্য। জায়গাটি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাসির উদ্দিনের বাড়ির বাগান।
প্রতি শুক্রবার এই বাগান রূপ নেয় শিশুদের মিলনমেলায়। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নাফিজা বলেন, “এখানে সব ঋতুতেই উৎসব হয়। ছবি আঁকতে, খেলতে, বই পড়তে আসতে ভালো লাগে।”

৭৫ বছর বয়সী নাসির উদ্দিনের স্বপ্ন—“শিশুদের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চাই।” তিনি নিজের ৩৩ শতাংশ জমিতে গড়ে তুলেছেন ‘কুলছুম নেছা–জালাল গান্ধী শিশুপার্ক’। রয়েছে পাঠাগার, জাদুঘর, সংবাদ সংগ্রহশালা, শরীরচর্চা কেন্দ্র ও শতাধিক বিরল প্রজাতির গাছ।
২০০৫ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে পেনশনের টাকায় এই শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠা করেন নাসির। তিনি বলেন, “শিশুরা যেন প্রকৃতি, ইতিহাস আর বইয়ের সঙ্গে মিশে বড় হয়—এই ইচ্ছা থেকেই শুরু।”
পার্কে প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছ রয়েছে—ফলশাহী, বনকাঁঠাল, ঢেপড়, হরগৌড়ি, মিষ্টি আমলকীসহ অনেক বিলুপ্তপ্রায় গাছ। প্রতিটি গাছে নাম লেখা আছে, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে।
বাগানের মাঝখানে তাঁর মায়ের নামে পাঠাগার ও জাদুঘর। পাঠাগারে শিশুদের মেধা ও শরীর গঠনবিষয়ক পাঁচ শতাধিক বই রয়েছে। জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে সেন ও পাল যুগের ইট, থালা, পানের বাটা, হারিকেন, ঢেঁকি, পালকি, ডাকটিকিট, নাঙল, মাথালসহ গ্রামীণ জীবনের শতাধিক নিদর্শন।

নাসির উদ্দিন জানান, নানি ও মায়ের পুরোনো সামগ্রী থেকেই জাদুঘর গড়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, শিশুরা এখানে এসে অতীতকে জানতে পারে, শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়।
স্থানীয় গৃহিণী রওশনআরা বলেন, নাসির স্যার শিশুদের নিয়ে পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, ফল উৎসবসহ নানা আয়োজন করেন। মেয়েকে নিয়ে আসলে মনে হয় শহরের বাইরে স্বপ্নের দেশে এসেছি।
শিক্ষার্থী আছিয়া খাতুন বলে, নাসির স্যার বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও তাঁর মনটা শিশুদের মতো। গাছ, পাখি, বই—সবই তাঁর ভালোবাসা।
কয়া গ্রামের বাসিন্দা আকাশ আহমেদ বলেন, নাসির স্যার খুব সাদামনের মানুষ। গ্রামের সব শিশু তাঁর বাগানকে নিজের বাড়ির মতো ভালোবাসে।
কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, নাসির উদ্দিনের মতো মানুষ সমাজের আলোকবর্তিকা। তাঁর উদ্যোগে শিশুরা যেমন শিখছে, তেমনি প্রকৃতির কাছেও ফিরছে।
তিনি জানান, গত বছর তিন লাখ টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, ভবিষ্যতে পার্কটির অবকাঠামোগত উন্নয়নে আরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।
নাসির উদ্দিনের স্বপ্ন একটাই — একদিন এখানে হবে শিশুরাজ্য, যেখানে বই, গাছ আর হাসির সুরে বড় হবে নতুন প্রজন্ম।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল