মিতু মন খারাপ করে পড়ার টেবিলে বসে আছে। সামনে বই মেলে রেখে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। বিজলীর চমকে অন্ধকার আলো হলে গাছপালা সুন্দর দেখায় জানালা ফাঁক দিয়ে। ছবি তোলার মতো আনন্দ হয় মিতুর। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে জানালা খুলতে মানা। সেতুকে ঘরে ঢোকানো চলবে না। আব্বু-আম্মুর এমন আচরণ সেতুর অপরিচিত।
মিতুর কাছে ওর বাবা আধ্যাত্মিক টাইপের কিছু। রাগ নেই, চোখ দুটোতেও সব সময় হাসি। আজ সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ বদলে যেতে হবে কেন? সেতুকেই বা ঘরে ঢুকতে দেয়া যাবে না কেন? ভাবতে ভাবতে মিতুর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
সেতু তখন তিন-চার মাসের হবে। সকালে হাঁটতে গিয়ে মিতু আর ওর আম্মু ধরলা সেতুর পাড়ে পায় সেতুকে। চিকন স্বরে মিউ মিউ করছিল। সাদার মধ্যে ছোপ ছোপ বাদামী রঙের সেতুকে দেখে মিতুর খুব মায়া হয়। কোলে তুলে আদর করে। বিড়ালছানা আম্মুর তেমন পছন্দ না। কোল থেকে নামাতে বলেন। মায়ের বকাবকিতে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। বাসার গেটে যখন তখন সেই মিউ মিউ শুনতে পায় মিতু। পেছন ফিরে দেখে সেতুর উপরে রেখে আসা বিড়ালছানাটি পিছু পিছু চলে এসেছে। ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নেয় মিতু।
বিষয়টি মা ভালোভাবে নেননি। প্রায়ই সেতুকে ঝাড়– নিয়ে তাড়া করেন। সেতুও দিনে দিনে চালাক হয়েছে। মাকে দেখলেই লুকিয়ে পড়ে। খুব গোপনে মিতুর সঙ্গে মেলামেশা করে, মিতুর বিছানায় শুয়ে থাকে, চুপি চুপি মিতুর দেওয়া খাবার খায়।
স্কুলের সময় হলে মিতুর পায়ে পায়ে থাকে। যেতে দিতে চায় না। বহুকষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে স্কুলে যেতে হয় মিতুকে। ফেরার সময় হলে অর্ধেক রাস্তা থেকে এগিয়ে নিয়ে আসে মিতুকে। মিতু গল্প করে আর সেতু ‘মিউ মিউ’ বলে সেই গল্পের কথায় সাড়া দেয়। আনন্দিত হলে লাফাতে থাকে।
কয়েকদিন ধরে আম্মু সেতুকে একদম সহ্য করতে পারে না। বাবাও। বলে, ‘সেতু অসুস্থ। ওর কাছ ঘেষতে মানা।’ হঠাৎ একদিন বড় বোনের বাসায় যেতে হলো মিতুকে। এক সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরে সেতুকে দেখতে পায় না। বাবা-মাও কিছু বলতে পারে না। খুঁজতে খুঁজতে বাগানে যায় মিতু। জামরুল গাছের নিচে শুয়ে থাকতে দেখে সেতুকে। মিতু এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে সেতুকে। গায়ে হাত দিতেই গোঙানি দিয়ে ভয় ভয় চোখে মিতুর মুখের দিকে তাকায়। ব্যথায় মুড়িয়ে আছে যেন। কিন্তু মিতুকে দেখেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মিতুও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর মিতু বাড়িতে ফেরে। সেতুও পিছু পিছু আসে।
মিতু রুমে গিয়ে জামাকাপড় পাল্টে নেয়। সেতু সোফায় বসে মিতুকে দেখতে থাকে। কতো কিছু যেন বলতে চায়। খানিক পরে মিতু কোলে নেয় ওকে। সেতু কোলে থাকতে চায় না। মিতুর জামায় বারবার কামড় দিতে থাকে। মিতু বুঝতে পারে সেতু নামতে চাচ্ছে। তাই কোল থেকে নামিয়ে দেয়। তারপর থেকে মিতু আর দেখেনি সেতুকে।
ফজরের নামাজ পড়তে উঠে মিতুর আম্মু সেতুর গোঙানি শুনতে পায়। মানুষের মতো। মিতুর রুমের সামনে থেকে শব্দ আসছে। আম্মু এগিয়ে গেলে লাফালাফি শুরু করে সেতু। ভয়ঙ্করভাবে মাটিতে পা আঁচড়াতে থাকে। মিতুর আম্মু ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মিতুর আব্বু। সেতুর লাফালাফি দেখে ভয়ে তিনিও দূরে সড়ে যান। মিতু বের হতে যাবে এমন সময় বাবার আওয়াজ শুনতে পায়, ‘মা, ঘর থেকে বের হবি না। সেতু পাগল হয়ে গেছে।’
সকালে উঠে এসব কি শুনছে সে? মিতু বাইরে বের হতে চায়। সেতু পাগল হয়ে যাবার বিষয়টি কিছুতেই মানতে নারাজ। ধীরে ধীরে দিনের আলোয় আলোকিত হয় সবকিছু। সেতু চলে গেছে। সবকিছু স্বাভাবিক। হঠাৎ জানালার ফাঁক গলে সেতুর পাগলামি লক্ষ্য করে মিতু। খুব আনন্দিত হলে এমন পাগলামি করে সেতু। চুপ করে জানালা খুলে দেয় মিতু। আগে এক লাফে ঘরে ঢুকে পড়তো সেতু। আজ তিন লাফে এসে মিতুর সঙ্গে খুনসুটি শুরু করলো। মিতু মনটা আনন্দে ভরে যায়। যাক তাহলে সব ঠিক আছে। সেতুকে কোলে তুলে চুমুু দিতে থাকে। মিতু দরজা খুলতেই দৌঁড়াতে থাকে। মিতুও দৌঁড়ে যায় পিছুপিছু।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে গাছের নিচে গিয়ে দেখে সাদা ফুটফুটে দু’টি বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। বাচ্চার কাছে গিয়ে কি যে লাফালাফি। মিতুও ঘুমন্ত বাচ্চার গায়ে আদর করতে করতে চিৎকার দিতে থাকে, ‘আব্বু দেখে যাও, আম্মু দেখে যাও আমার সেতু পাগল হয়নি।