ভ্রমণে শিশুর মেধার বিকাশ ঘটে। এ উক্তিটির সাথে পারুর বাবা একমত। তাই তো তিনি ছুটির দিনে মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। ঘুরে ঘুরে মেয়েকে সবকিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সামনে লম্বা ছুটি। তিনি ঠিক করলেন ছুটিতে মেয়েকে নিয়ে বাইরে ভালো কোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন?
রাতে সবাই খেতে বসেছে। মা-বাবা আর পারু। বেলী খালা খাচ্ছেন না। তিনি টেবিলে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। বেলী খালা মায়ের দূর সম্পর্কের কেমন যেন আত্মীয় হয়। তার স্বামী নেই। মারা গেছেন। এক মেয়ে আছে। নাম ফুলকি। গ্রামে থাকে। দাদির কাছে। গ্রামের এক হাইস্কুলে পড়ে। ক্লাস সেভেনে। বেলী খালার স্বামী মারা যাওয়ার পর মা বেলী খালাকে নিয়ে এসেছেন। সেই থেকে বেলী খালা পারুদের বাসায় থাকেন। পারুর বাবা-মা চাকরি করেন। সকালে উঠে তারা পারুকে স্কুলে দিয়ে অফিসে চলে যান। স্কুল ছুটি হলে বেলী খালা গিয়ে পারুকে নিয়ে আসে। পারু সারা দিন বেলী খালার সঙ্গে থাকে। বেলী খালা খুব ভালো। পারুকে খুব ভালোবাসে। আদর করে। গল্প বলে। ভূতের গল্প। রাজকুমার-রাজকুমারীর গল্প। রূপকথার গল্প। এক দিন বলল, পারু মা?
জ্বি খালা।
আজ তোমাকে একটা গল্প বলব।
গল্প বলবে? ওয়াও! কী মজা! কী মজা! পারু আনন্দে হাততালি দেয়।
তা দেখে বেলী খালা হাসেন।
আজ তোমাকে সাত ভাই চম্পার গল্প শুনাব। খুব ভালো গল্প। ওই গল্পের নায়িকার নাম কিন্তু তোমার নামে নাম।
পারু চোখ বড় বড় করে বলে, পারু?
হুম, পারু।
শুনে আরও খুশি হয় পারু। হি হি হি করে হাসে। বল খালা। গল্পটা তাড়াতাড়ি বল।
বেলী খালা গল্প বলে। সাত ভাই চম্পার গল্প। পারুর গল্প। পারু খুব ভালো মেয়ে ছিল। সবাই তাকে ভালোবাসে। বনের পশু-পাখিও ভালোবাসে। তার সাথে কথা বলে।
গল্প শুনে পারু ভাবে, আমার নামও তো পারু। আমি যদি বনে যাই তাহলে কী বনের পশু-পাখি আমার সাথেও কথা বলবে?
ইশ, আমিও যদি পারুর মতো একবার বনে যেতে পারতাম!
ভাত খেতে খেতে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথাটা সবাইকে বলল পারুর বাবা। বলল, তোমরা বল তো, কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়?
বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে পারু খুব খুশি হলো। বলল, বাবা, আমরা বন দেখতে যাব।
কোন বন?
যে বনে বাঘ থাকে। হাতি থাকে। সব পশুপাখি থাকে।
ঠিক আছে মা, তাই হবে। বললেন পারুর বাবা।
পারু খুব খুশি হলো। বাবার গলা জড়িয়ে ধরল। বাবার দুই গালে দুটো বড় বড় পাপ্পা দিল। থ্যাংক ইউ বাবা!
পারুরা বনে গিয়ে এক বাংলোয় উঠেছে। বেশ সুন্দর বাংলোটা। খুব পছন্দ হয়েছে পারুর। বাংলোর সামনে সারি সারি ফুলের বাগান। বাগানে নানান রঙের ফুল ফুটেছে। ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ছে। উড়ে উড়ে তারা ফুলের সাথে খেলা করছে। ফুলগুলো দুলছে। হাসছে।
পাশ দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। ছোট নদী। নদীটি সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে বনের গহিনে।
বাবা-মা জার্নি করে এসে ক্লান্ত। তারা বাংলোয় বিশ্রাম নিচ্ছেন।
পারু বাংলোর বাইরে ফুল বাগানে হাঁটছে। ফুল দেখছে। প্রজাপতি দেখছে। হঠাৎ একটা সোনালি রঙের ডোরাকাটা প্রজাপতি এসে পারুর কাঁধে বসল। তা দেখে পারু হাসে। হাত দিয়ে প্রজাপতির গায়ে আলতো করে আদর করে। কী রে, তোমার নাম কী?
প্রজাপতিটা কথা বলল! বলল, আমার নাম পারু। প্রজাপতির কথা শুনে পারুর চোখ কপালে উঠল। বল কী?
প্রজাপতিটা আবার কথা বলল। হুম পারু। আমার নাম পারু। সাত ভাই চম্পার পারু। এই ফুলেগুলো আমার ভাই। ভাইয়েরা মারা যাওয়ার পর ফুল হয়ে গেছে। আর আমি হয়েছি প্রজাপতি। আমরা ভাই-বোনেরা ফুল-প্রজাপতিরা প্রতিদিন খেলা করি।
সব শুনে পারু তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সবকিছু তার কাছে মনে হচ্ছে যেন বেলী খালার বলা কোনো রূপকথার গল্প!
প্রজাপতি পারুকে বলল, আমার এক বন্ধুর ভীষণ বিপদ। তুমি তাকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা কর।
পারু বলল, কার বিপদ?
সাদা হাতিছানার।
সাদা হাতিছানার!
হুম।
কী বিপদ?
সাদা হাতিছানার মাকে বনদস্যুরা ধরে নিয়ে গেছে। তুমি তার মাকে বাঁচাও।
কোথায় সাদা হাতিছানা?
ওই যে সামনে নদীর তীরে।
পারু সামনে যায়। নদীর তীরে। দেখে একটা সাদা হাতির বাচ্চা বসে আছে। বসে বসে কাঁদছে। মা মা বলে চিৎকার করছে।
পারু তার কাছে যায়। হাঁটু গেড়ে বসে। তুমি কাঁদছো কেন হাতি বন্ধু?
মায়ের জন্য।
কোথায় তোমার মা?
খারাপ লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে।
কোথায়?
আমি জানি না। বলে আবার কাঁদতে লাগল হাতিছানা।
পারু প্রজাপতি পারুকে বলল, হাতি বন্ধু তো তার মায়ের কথা বলতে পারছে না। আমি কীভাবে তার মাকে খুঁজে দেব?
তুমি হাতিকে বল, চল কালো পাহাড়ে যাই।
পারু হাতির ছানাকে বলল।
হাতির ছানা রাজি হলো।
পারু হাতিছানার পিঠে বসল।
হাতি চলল।
পারু কালো পাহাড়ের কাছে এসে দেখল বনদস্যুরা বড় সাদা হাতিকে বেঁধে রেখেছে। পারু বুঝতে পারল এটাই হাতিছানার মা। হাতির অনেক দাম। বনদস্যুরা মা হাতিকে পাচার করবে। বিক্রি করে দেবে। চিড়িয়াখানার লোক এসেছে। পাচারকারীরা কথা বলছে। দর কষাকষি হচ্ছে।
পারু দ্রুত সেখান থেকে ফিরে আসে। পুলিশ স্ট্যাশনে যায়। পুলিশকে সব খুলে বলল। পুলিশ গিয়ে পাচারকারীকে ধরে ফেলল। মা হাতিকে ছেড়ে দিল।
মা হাতি ছাড়া পেয়ে তার ছানার কাছে ছুটে গেল। শুঁড় দিয়ে ছানাকে আদর করতে লাগল। তা দেখে পারুর চোখে পানি চলে এলো।
পারু, এই পারু, উঠ। সকাল হয়ে গেছে তো। আমরা এখন বেরোব। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। বলল পারুর মা।
ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল পারু। তাহলে এতক্ষণ সে কী স্বপ্ন দেখছিল! নিজে নিজে মুচকি হাসে পারু।
তারপর উঠে ফ্রেস হয়ে তৈরি হলো।
তারা বনে পৌঁছল বিকালে। উঠল বাংলোয়।
বাংলোটা খুব সুন্দর। সামনে ফুলের বাগান। বাগানে ফুল ফুটেছে। নানান রঙের ফুল। ফুলে ফুলে উড়ছে নানান রঙের প্রজাপতি। বাগানের দিকে তাকিয়ে পারুর বাগানটা খুব চেনা চেনা মনে হলো। কোথায় যেন দেখেছে এই বাগান! ভাবে পারু।
হঠাৎ তার মনে পড়ল স্বপ্নের কথা। আরে এ যে আমার স্বপ্নে দেখা সেই বাগানটাই!
পাশে নদী। বয়ে গেছে বনের ভিতরের দিকে। পারু নদীর দিকে তাকাল। তাকিয়েই দেখতে পেল নদীর তীরে হাঁটছে একটা সাদা হাতি ও তার ছানা।