এখনো অধরা রয়ে গেছেন রিজার্ভ কারসাজির ‘হোতা’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজী সাইদুর রহমান। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ডলারের দাম আটকে রেখে এবং সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের অর্থ রিজার্ভে যুক্ত করে তা ফুলিয়ে দেখাতেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে খুশি করতে এবং গভর্নর হওয়ার প্রত্যাশায় এই কৌশল নিয়েছিলেন কাজী সাইদুর। আওয়ামী সরকারের পতনের পর তাঁকে দায়িত্ব ছাড়তে হয়, বর্তমানে তিনি লাপাত্তা।
কাজী সাইদুর রহমানকে একসময় রিজার্ভের ‘হিরো’ বলা হতো। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। তখন তিনি নিজে সাংবাদিকদের এসএমএস করে প্রতিনিয়ত সেই তথ্য পাঠাতেন।
অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে না চাইলেও রিজার্ভের খবর প্রচার তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়, সেই রিজার্ভ আসলে এক ধরনের ফোলানো বেলুন ছিল, যা ঋণ ও ছলচাতুরির ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছিল।
অভিযোগ রয়েছে, কাজী সাইদুরের কারসাজিতে করোনা-পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহও সাময়িকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সংখ্যাটি আরো স্ফীত হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটাই পরে দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
কারণ বাস্তবতা অনুযায়ী যদি ডলারের দাম আগে সমন্বয় করা হতো, তবে আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোকে এত বিপাকে পড়তে হতো না। অবশেষে ২০২৪ সালে এসে বাধ্য হয়ে টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়, যদিও তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
কাজী সাইদুরের দুর্দশা শুরু আরো আগে। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং দুটি ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের আমলে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচারের সহযোগী ছিলেন তিনি।
ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সঙ্গে দীর্ঘ ২৫ বছর জড়িত থাকায় ডলার কেনাবেচা, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও মূল্য নির্ধারণে তাঁর একক কর্তৃত্ব তৈরি হয়েছিল। ডলার সংকট তীব্র হলে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। তখনকার গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার তাঁকে সরিয়ে দেন, অবশ্য তিনিও এখন পলাতক।
২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠা রিজার্ভ মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে অর্ধেকে নেমে আসে। এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদরা চারটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছেন— ১. কভিড-পরবর্তী আমদানির চাপ ও জ্বালানি-খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধি; ২. বৈদেশিক ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ; ৩. রেমিট্যান্স প্রবাহে শ্লথ গতি ও হুন্ডির প্রভাব ও ৪. রপ্তানি আয়ে স্থবিরতা।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো—আমদানির আড়ালে অর্থপাচার। অনেক আমদানিকারক প্রকৃত দামের চেয়ে দ্বিগুণ দামে পণ্য দেখিয়ে এলসি খোলেন। যেমন—১০ ডলারের পণ্য কাগজে ২০ ডলার দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ডলার ছাড়ানো হতো। অতিরিক্ত অংশ বিদেশে থেকে যেত, যা মূলত পাচার। দুর্বল শুল্কায়ন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির ঘাটতি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে এটি বছরের পর বছর চলেছে। এতে রিজার্ভ দ্রুত ক্ষয় হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এর প্রধান সহযোগী ছিলেন কাজী সাইদুর রহমান।
রিজার্ভ ফুলিয়ে দেখানোর প্রমাণ মেলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনে। ২০২১ সালের অক্টোবরে আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বহির্ভূত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৭.২ বিলিয়ন ডলার বেশি দেখিয়েছে। ২০২১ সালের খসড়া সুরক্ষা মূল্যায়নে বিদেশি সম্পদের ভুল শ্রেণিবিন্যাস ধরা পড়ে। এতে ৪৬ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলারের মতো। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, শুধু রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ওপর ভরসা করে রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা যাবে না। আমদানির আড়ালে পাচার রোধ, ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও ডলারের বাজার বাস্তবতার সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় আবার একই ধরনের ধস দেখা দিতে পারে।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে দাঁড়ায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে তিন বছরের ব্যবধানে সেই রিজার্ভ কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, একাধিক অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণ মিলে এ পতন ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব বলছে, চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বরের হিসাবে এখন দেশের গ্রস রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ এখন ২৬ বিলিয়ন ডলার (বিপিএম-৬)।
সর্বশেষ তথ্যমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান ৩৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ, অর্থপাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁদের বিষয়ে এরই মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। সেগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। অনুসন্ধানে কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই তালিকায় কাজী সাইদুর রহমানও রয়েছেন।
গত ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর (এস কে সুর) ব্যক্তিগত লকার খুলে চার কোটি ৬৯ লাখ টাকার অর্থসম্পদ পায় দুদক। ঢাকায় তাঁর বাসায় তল্লাশিকালে ১৬ লাখের বেশি টাকা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখা গোপন লকারের তথ্য পায় সংস্থাটি। এরই সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা (কয়েন) ভল্টে অন্য কর্মকর্তাদের লকার খোলার ব্যাপারে আদালতের অনুমতি নিয়েছে দদুক।
দুদক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও মো. আব্দুর রউফ তালুকদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে। সংস্থার আতশি কাচে রয়েছেন ডেপুটি গভর্নর মোছা. নুরুন্নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, কাজী সাইদুর রহমান, উপদেষ্টা আবু ফারাহ মো. নাসের, নির্বাহী পরিচালক ড. সায়েরা ইউনুস, পরিচালক ইমাম আবু সাঈদ, পরিচালক (এফপিআইবি) সরোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত পরিচালক আবদুর রউফ, মঞ্জুর হোসেন খান, মহাব্যবস্থাপক জাকির হোসেন, যুগ্ম পরিচালক সুনির্বাণ বড়ুয়া, জোবায়ের হোসেন, নিক তালুকদার, রুবেল চৌধুরী, লেলিন আজাদ পলাশ, উপমহাব্যবস্থাপক তরুণ কান্তি ঘোষ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদৌস কবির, পদস্থ কর্মকর্তা এ বি এম মোবারক হোসেন, উপপরিচালক হামিদুল আলম সখা, সহকারী পরিচালক মো. কাদের ও সহকারী ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন।
দুদকের তালিকায় সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, খুরশিদ আলম, সাবেক পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ, সাবেক উপপরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বরখাস্ত) সিকদার লিয়াকত ছাড়াও বিএফআইইউয়ের তিন অতিরিক্ত পরিচালক, দুই যুগ্ম পরিচালক ও এক উপপরিচালক রয়েছেন।