মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে তার ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দিয়েছেন, ‘গুজব ছড়ানো হয়েছে, আমাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে বদলি করা হয়েছে। এমনকি টিভিস্ক্রলেও প্রচার করা হয়েছে। ওরা থেমে নেই।’ এ পোস্টটি নানান রকম আলোচনায় এসেছে। সিভিল প্রশাসনে চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন বোধগম্য কারণেই। যা হাড়ে হাড়ে টের পেতে নিশ্চয়ই বেশি সময় লাগেনি মেধাবী এ কর্মকর্তার। এমনকি তিনি এতটাই টের পেয়েছেন যে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন তার অবস্থা সম্পর্কে। কিন্তু তার পোস্টে কিঞ্চিৎ সংশোধন প্রস্তাব আনা যেতে পারে যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ‘...ওরা থেমে নেই।’ বাস্তবতার আলোকে বাক্যটি হওয়া উচিত, ‘ওরা থেমে থাকে না।’ আসলে মাদক মাফিয়ারা কখনোই থেমে ছিল না, তারা থেমে থাকে না!
মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন প্রায় সাড়ে সাত মাস আগে, ২০১৭ সালের ২৯ জুন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এতদিনের দক্ষতা ও সততার সঙ্গে বাড়তি কিছু দায়িত্ব ও স্বপ্ন দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন জামাল উদ্দীন আহমেদ এমনটি ধারণা করাই সঙ্গত। তবে সম্ভবত তিনি কেবল সামনেই তাকিয়েছেন আর পিছনে তাকানোর চেষ্টা করেননি অথবা তাগিদ বোধ করেননি। তা না হলে তিনি যে কারও চেয়ে বেশি টের পেতেন, তিনি আসলে কণ্টকাকীর্ণ আসনে বসে আছেন এবং মাথার ওপরে খুবই নাজুক অবস্থান থেকে ঝুলে আছে শাণিত চকচকে একাধিক তরবারি, যা নানান কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে মাদক ব্যবসার মাফিয়া চক্র। কিন্তু তিনি এসব দিকে তাকিয়েছেন বলে মনে হয় না। যদিও নিদেনপক্ষে তার পেছনে দেয়ালে সাঁটানো বোর্ডের দিকে তাকালেই বুঝতেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে বেশি দিন টেকার রেকর্ড তেমন নেই। যে কারণে ১৯৯০ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২৮ বছরে মহাপরিচালক পদে তিনি ৩৩তম ব্যক্তি, এর মধ্যে ১০ জন দায়িত্ব পালন করেছেন ভারপ্রাপ্ত ও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে। এমনকি ‘রুটিন দায়িত্ব’ পালন করার মতো মহাপরিচালকও ছিলেন এ সংস্থার। আর নব্বই ভাগ মহাপরিচালকই বছর পার করতে পারেননি। আবার অনেকেই ছিলেন মাসকয়েক মাত্র। মো. জামাল উদ্দীনের ঠিক আগের মহাপরিচালক অপসারিত হয়েছেন মাত্র তিন মাসের মধ্যে!
ঘন ঘন উইকেট পড়ার মতো মহাপরিচালক পরিবর্তন হওয়ার অর্থ এই নয় যে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর হালকা কোনো সংস্থা। বরং এ সংস্থাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকের বিবেচনায় লোভনীয়। এরপরও মহাপরিচালক পদে পরিবর্তন হচ্ছে ঘন ঘন। ফলে মহাপরিচালক পদটি দাঁড়িয়েছে অনেকটা কচুপাতার মতো, যে কোনো সময় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা! এবং এ ধারার শুরু সংস্থাটির সূচনালগ্ন থেকেই। প্রথম মহাপরিচালক আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ছিলেন এক বছরের কম সময়। দ্বিতীয় মহাপরিচালক এম এনামূল হক ছিলেন ছয় মাসেরও কম, আর তিন মাসেরও কম মেয়াদে ছিলেন মহিউদ্দিন আজাদ, প্রায় একই সময়সীমার মধ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন মনোয়ারুল ইসলাম। এ ধারায় ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগলাভ করেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ সালাম। তাকে বিবেচনা করা হয় অধিদফতরের ইতিহাসে সবচেয়ে দক্ষ ও ফাংশনাল মহাপরিচালক হিসেবে। কিন্তু তাকেও বিদায় করা হয় এক বছর এক মাস তের দিনের মাথায় ২০০৩ সালের ১০ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অফিস থেকে এক ফ্যাক্সবার্তার মাধ্যমে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ১৫তম মহাপরিচালক মোহাম্মদ সালামকে বিদায় করা হয় ইয়াবা ট্যাবলেট আটকের প্রথম ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়েই সচেতন মহলের কাছে নগ্নভাবে ধরা পড়ে মাদক মাফিয়া চক্রের দাপুটে উপস্থিতি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ২০০৩ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালককে বিদায় করার পর মাদক মাফিয়া চক্র দ্রুতগতিতে এগিয়েছে, একপর্যায়ে পরিণত হয়েছে বিষবৃক্ষে।  খোঁজখবর যারা রাখেন তারা জানেন, কেবল মহাপরিচালক নয় ইন্সপেক্টর লেবেলের কর্মকর্তাদেরও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। এ ধারায় অনেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আছেন। দৃশ্যত এদের দাপটের কর্মকর্তা মনে হলেও এদের অনেকেই আসলে মাফিয়া চক্রের ক্রীতদাসের মতো। এরা লাগাতারভাবে সুবিধাজনক পোস্টিংয়ে থাকার সুযোগ পান, যারা নিয়ন্ত্রিত হতে চান না তাদের নানা অজুহাতে হয়রানি করা হয়। আর এটা করা হয় অধিদফতরের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যেই, যা বাইরে থেকে ধারণা করা খুব একটা সহজ নয়। আবার অন্য সংস্থা থেকে আসা যেসব কর্মকর্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। আর যাদের সরানো সম্ভব হয় না তাদের চারদিকে একটি শক্ত বলয় সৃষ্টি করা হয় যাতে তারা খুব বেশি ‘নড়াচড়া’ করতে না পারেন। এমনকি মাফিয়া চক্রের পছন্দ না হলে অধিদফতরে যোগদান করতে না দেওয়ারও উদাহরণ আছে। ফলে পরিচালকের চারটি পদের মধ্যে অর্ধেকই প্রায় দীর্ঘ সময় ধরে শূন্য থাকে, এমনকি তিনটি পদও শূন্য থাকার রেকর্ড আছে। এর সঙ্গে রয়েছে তীব্র জনবল সংকট। বিপরীতভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের জনবল ও শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ।
কেবল পরিচালক পর্যায়ে নয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের আরও অনেক পদ শূন্য। আর পদ পূরণ না হওয়ায় অধিদফতরের জনবল দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। ২০০২ সালের তুলনায় জনবল কমেছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ। এদিকে অধিদফতরের জনবল বৃদ্ধির কথা প্রায়ই বলা হলেও বাস্তবে তা করা হয় না। আর এ ক্ষেত্রে এমন সব বিষয় সামনে আনা হয় যা পেরিয়ে নতুন নিয়োগের মাধ্যমে জনবল বৃদ্ধি করা মোটেও সহজ নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়োগের বিষয়টি কঠিন করে রাখা হচ্ছে নানান কৌশলে। যে কারণে ১৯৯০ সালের সূচনালগ্নের এক হাজার ২৬৩ জনের জনবলের অর্গানোগ্রামেই চলছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তাই বলে এ জনবল কিন্তু বাস্তবে নেই, অবসর এবং অন্যান্য কারণে জনবল কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭০০। ২০১৪ সালে ১৭০৬ জনবল নির্ধারণ করে নতুন অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হয়। কিন্তু এর আওতায় জনবল নিয়োগ দেওয়া যায়নি রিক্রুটিং রুলের অনুপস্থিতিতে। অথচ এর আওতায়ই ৬৪ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অফিস খোলা হয়েছে। ফলে এ অফিস পাহারা দেওয়া ছাড়া বিশেষ কাজ খুব একটা করা যায় না জনবলের অভাবে। রাজধানীতে জনবল সংকটও তীব্র। এ অবস্থার মধ্যে সম্প্রতি অধিদফতরের জনবল বৃদ্ধির জন্য একটি প্রস্তাবনা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আতিকুল হক জনবল বৃদ্ধির এ উদ্যোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, জেলাপর্যায়ে ন্যূনতম ৩০ জন জনবল থাকবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আতিকুল হক আরও জানান, তিন শ্রেণিতে ভাগ করে জেলায় সর্বোচ্চ জনবল থাকবে ৫০ থেকে ৫৫ জন, প্রস্তাব অনুসারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে জনবল দাঁড়াবে প্রায় আট হাজার। কিন্তু এ জনবল বাস্তবে কবে পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ঘোরতর সংশয় রয়েছে। এদিকে যানবাহনের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এমনও বিভাগ আছে যেখানে কয়েকটি জেলার জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি পিকআপ ভ্যান, কাব্য করে বলা যায়, সবেধন নীলমণি!
যানবাহন আর জনবল সংকট কেবল নয়; মর্যাদার প্রশ্নেও নাজুক অবস্থানে আছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। যেখানে পুলিশ ইন্সপেক্টরা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা সেখানে মাদকের ইন্সপেক্টরা পদে দ্বিতীয় শ্রেণির হলেও এখনো ব্যক্তিটি তৃতীয় শ্রেণিরই থেকে গেছেন। এদিকে পদোন্নতির অবস্থা আরও শোচনীয়। যোগদানের পদে থেকেই অবসরে যাওয়ার বহু উদাহরণ আছে। আবার অনেক আশা নিয়ে মেধাবীরা যোগদান করলেও তাদের মধ্যে অনেকেই বিসিএস ফেস করে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি নিয়ে চলে যান। মাদকের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে নিয়োজিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের অবস্থা অনেকটা ‘সারা অঙ্গে ঘা’-এর মতো। এ অবস্থা থেকে অধিদফতরকে টেনে তোলার প্রত্যয় এবং মাদকের আগ্রাসন প্রতিরোধের স্বপ্ন দেখেন সঙ্গত কারণেই প্রধান নির্বাহীরা। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা প্রায় ক্ষেত্রেই হয় খুবই তিক্ত। যে তিক্ততার মধ্য দিয়ে বর্তমান মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন যাচ্ছেন বলে অনেকেরই ধারণা। ফেসবুকে তার পোস্টে এমনই ইঙ্গিত বহন করে। এর মাধ্যমে অবশ্য এক অর্থে তিনি বল ঠেলে দিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দিকে—এমনটাই মনে করেন অনেকে। ফলে এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বিজয়ী হবেন, নাকি অতীতের মতো এবারও বিজয়ী হবে মাদক ব্যবসার মাফিয়া চক্রের কালো হাত। মনে রাখা প্রয়োজন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকরা হঠাৎ বদলির নামে যতবারই পরাজিত হয়েছেন ততবারই দাপট বেড়েছে মাদক মাফিয়া চক্রের।
বি.দ্র. : দেশের যে অঞ্চলে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল পৌঁছানো সম্ভব হয়নি সে এলাকায়ও ইয়াবা ট্যাবলেট পৌঁছে গেছে— এ উক্তি করেছেন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সচিব আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়।
লেখক : সাংবাদিক।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        