ইমরুল কায়েস ষষ্ঠ শতকের আরবি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। আরবি ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদেরও একজন তিনি। তার পুরো নাম ইমরুল কায়েস বিন হুজর আল কিন্দি। বাবার নাম হুজর ইবনে আল-হারিস এবং মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে রাবিয়াহ আল-তাগলিবি। ইমরুল কায়েস আরবের নাজাদ এলাকায় ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে কিনদাহ রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রাজপুত্র হিসেবে প্রথম জীবনে রাজকীয় জীবনযাপন করেন তিনি। কিশোর বয়সে কাব্যচর্চা শুরু করলে ইমরুল কায়েসের বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এর পর থেকে তিনি ভবঘুরে বাউ-ুলে জীবন শুরু করেন। বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো এবং সারাক্ষণ মদে চুর হয়ে থাকা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ইমরুল কায়েসের এই অস্বাভাবিকতার জন্য চাচাতো বোনের সঙ্গে গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা দায়ী ছিল। তার প্রেমিকার নাম ছিল উনাইজা।
নাজাদের সুবিখ্যাত কিনদাহ রাজ পরিবারের আদি আবাসস্থল ছিল দক্ষিণ আরব, সেখান থেকে কিনদাহ বংশের লোকেরা উত্তরে অগ্রসর হয়ে চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতাব্দীর দিকে নাজাদে বসবাস শুরু করে। সেখানে তারা প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিভিন্ন গোত্রের ওপর বিস্তার হয় তাদের আধিপত্য। তার আগে ওই এলাকায় আসাদ ও গাতফান বংশের রাজত্ব ছিল। পঞ্চম শতাব্দীর দিকে কিনদাহ পরিবার ইয়েমেনের রাজাকে নাজাদের জন্য একজন রাজা ঠিক করে দেওয়ার আবেদন জানায়। ইয়েমেনের রাজা ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হুজর আকিল আল-মুরারকে প্রথম কিনদাহ রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। হুজর আকিল আল মুরার রাজা হওয়ার পর এলাকার বেশির ভাগ গোত্র তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে তিনি তার ক্ষমতা সুসংহত করতে সক্ষম হন। হুজর আকিল আল-মুরারের পুত্র আমর বাবার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় রাজা হন। তার পুত্র আল-হারিস ছিলেন কিনদাহ রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি তৃ-তীয় রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আল-হারিসের পুত্র হুজর। যিনি ছিলেন কবি ইমরুল কায়েসের বাবা।
ইমরুল কায়েসের জন্ম নিয়ে ইতিহাসবিদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ধারণা করা হয় তিনি ৫০১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কিনদাহ বংশের রাজা হুজরের কনিষ্ঠ সন্তান। শৈশবে কবিতা লেখা শুরু করেন ইমরুল। কিন্তু তার বাবা পুত্রের কবি হওয়া ভালো চোখে দেখেননি। কারণ রাজার সন্তানের কবি হওয়া মানায় না, এমনটি ভাবতেন তিনি।বাবার অস্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তার অতিরিক্ত মদ্যপান ও নারী লিপ্সার মনোভাব। ইমরুল কায়েস তার চাচাতো বোন উনাইজাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে গোপন সম্পর্ক রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। পরিবারের জন্য লজ্জাজনক হওয়ায় ইমরুল কায়েসের বাবা তাকে তাজ্যপুত্র করেন। মনে করা হয় পিতার স্ত্রী ও দাসীদের নিয়ে বাজে কবিতা লেখার জন্য ক্ষুব্ধ রাজা রাজপুত্র ইমরুলকে বর্জন করেন।
প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে রাজা হুজর নিহত হন। এ যুদ্ধে ইমরুল কায়েস তার বাবার সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছেন, এমন কথা বলেছেন তার জীবনীকারদের কেউ কেউ। তবে এ বিষয়ে ভিন্নমতও রয়েছে। ইবনে আল-কালবির মতে, ইমরুলের বাবা যখন মারা যান তখন তিনি নির্বাসনে ছিলেন। পিতার মৃত্যুসংবাদ যখন তার কাছে পৌঁছায় তখন তিনি বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করছিলেন। মৃত্যু সংবাদ শোনার পর ইমরুল কায়েস বলেন, ‘আল্লাহ আমার বাবার প্রতি দয়াবান হোন। যখন আমি ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা আমাকে বিপথে ঠেলে দিয়েছেন। এখন আমি পূর্ণবয়স্ক আর তার মৃত্যুতে শোকাহত। আজ কোনো সতর্কতা থাকবে না এবং কাল থাকবে না কোনো উন্মত্ততা।’
ইমরুল কায়েসের প্রতি তার বাবা বিরূপ মনোভাব পোষণ করলেও ভাইদের মধ্যে তিনিই বাবার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। রাজা হুজরের হত্যার ঋণ শোধে হত্যার সঙ্গে জড়িত আসাদ গোত্র তার কাছে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করে এবং তিনটি প্রস্তাব দেয়। বলা হয় ইমরুল কায়েস তার পিতা হত্যার বদলে তাদের কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে হত্যা করবেন অথবা তিনি সহস্র ভেড়া ও উটের সমপরিমাণ অর্থমূল্য গ্রহণ করবেন অথবা তিনি তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন। সে ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তুতির জন্য এক মাস সময় দিতে হবে। ইমরুল কায়েস তৃতীয় উপায় পছন্দ করলেন। বকর ও তাগলিব গোত্র তাকে সমর্থন জানাল এবং আসাদ গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়। বকর ও তাগলিব গোত্র যখন বুঝল, হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট লোককে হত্যা করা হয়েছে তখন তারা কিনদাহ বংশের প্রতি তাদের সমর্থন তুলে নিল।
ইমরুল কায়েস আরবি ভাষায় লেখা বিখ্যাত কাব্য সংকলন মুআল্লাকার অন্যতম সেরা লেখক। এই প্রতিভাবান কবি ৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।