শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

কৃষক রহিমুল্লাহকে রাষ্ট্রপতির চিঠি

শাইখ সিরাজ

কৃষক রহিমুল্লাহকে রাষ্ট্রপতির চিঠি

বছর পাঁচ-ছয় আগের কথা। একদিন দুপুরে অফিসে রিসিপশন থেকে ফোনে জানাল কক্সবাজার থেকে রহিমুল্লাহ নামে এক কৃষক এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। দুপুরে রহিমুল্লাহকে নিয়ে খেতে বসলাম। বললাম, বলেন আমার কাছে কেন আসছেন? রহিমুল্লাহ খেতে খেতে শোনালেন তার জীবনের গল্প। সেই আশির দশকে বিটিভিতে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিলাম ছোট্ট ছোট্ট পেঁপে গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত গাছভর্তি পেঁপে ফলে এমন জাতের গাছের প্রতিবেদন। তা দেখে শৈশবেই বাবাকে ধরেছিলেন এমন জাতের পেঁপে গাছ এনে দিতে। ‘মাটি ও মানুষ’ দেখে দেখে কৃষির প্রতি তার ভালোবাসা জন্মে। এরপর জীবনের প্রয়োজনে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যে। সেখান থেকে স্যাটেলাইটের কল্যাণে দেখার সুযোগ পান চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’। মধ্যপ্রাচ্যের কঠিন জীবনযাপনের মধ্যে থেকেও মেসের একমাত্র বিনোদন তার এ কৃষি অনুষ্ঠান। বাউকুল চাষে বিভিন্ন কৃষকের সাফল্যের প্রতিবেদন দেখে তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। কষ্টে অর্জিত অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে এসে দুই বছর ধরে কুল চাষের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো সাফল্য পাচ্ছেন না। টাকাপয়সা যা বিদেশ থেকে এনেছিলেন সব শেষ। আমি সব শুনে বললাম, ভাত খান, ভাত খাওয়া শেষ করে থানায় গিয়ে আমার নামে মামলা করে দেন। এ কথা শুনে শতকষ্টে মলিন রহিমুল্লাহও হেসে দিলেন, কী বলেন স্যার! আমি তো আসছি অন্য কারণে। জানতে চাইলাম, কী কারণে? বললেন, আমার বিশ্বাস, একবার যদি, একবার যদি আপনি আমার জমিতে গিয়ে দাঁড়ান, তাহলেই ফলন ভালো হবে ইনশা আল্লাহ। এবার আমার হাসির পালা। বললাম, রহিমুল্লাহ, কৃষি সাধনার বিষয়। কৃষিতে সাফল্য আসে সত্য। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন কৃষির প্রতি সত্যিকারের প্রেম। এতে লেগে থাকতে হয়। তা না হলে সাফল্য আসে না। আপনি দুই বছরে বহুবার মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলেন। নিজে সম্পৃক্ত না থাকলে, অন্যকে দিয়ে নিজের কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া সম্ভব নয়। তখনকার মতো রহিমুল্লাহকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। মাস তিনেক পর তার বাগানটি দেখতে গেলাম। বিশাল বাগান। ঘুরে দেখে রহিমুল্লাহকে বললাম, নিজ মাটিকে ভালোবেসে, মাটির টানে আপনি দেশে ফিরে এসে কৃষি কাজে নিয়োজিত হয়েছেন, আপনার এ সততার সঙ্গে একাগ্রতা যুক্ত থাকলে আমার বিশ্বাস আল্লাহ আপনাকে ফেরাবেন না। বিদায় নিয়ে রহিমুল্লাহর বাগানের সামনে থেকে গাড়িতে উঠে রওনা করলাম। যেতে যেতে গাড়ির সাইড ভিউ মিররে লক্ষ্য করলাম রহিমুল্লাহ দৌড়ে দৌড়ে আসছেন। আমি গাড়ি থামাতে বললাম। গাড়ি থামলে রহিমুল্লাহও থেমে যান। আবার চলতে শুরু করলেই পেছন পেছন দৌড়ান রহিমুল্লাহ। আমি রহিমুল্লাহকে ডাকলাম, ব্যাপার কী? দৌড়াচ্ছেন কেন? তিনি পকেট থেকে দুটি কাগজ বের করলেন। একটি হলো বিদেশে কাজ করার অনুমতিপত্র (আকামা) আর একটি হচ্ছে বিমান টিকিট। তিনি বিমানের টিকিট টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। তার চোখে অন্যরকম এক দৃঢ়তা দেখেছিলাম। এখান থেকেই শুরু রহিমুল্লাহর কৃষিতে সাফল্য যাত্রা। ব্যক্তি হিসেবে রহিমুল্লাহ বেশ সৎ। তাকে বেশ কয়েকবার সুদহীন টাকা ঋণ দিয়েছি। প্রতিবারই তিনি সততার সঙ্গে টাকা ফেরত দিয়েছেন সময়মতো। শুধু বাউকুল নয়, পেঁপে, কলা চাষ করেও তিনি বেশ ভালোই টাকাপয়সা পাচ্ছেন। করেছেন মাছের খামার। মহল্লার বাজারে দিয়েছেন সার-বীজের দোকান। প্রতি বছরই কুলের মৌসুমে আমি তার কাছ থেকে কিছু পরিমাণ কুল কিনি। উদ্দেশ্য, রহিমুল্লাহ আদতে কৃষির সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত আছে তার একটা খবর রাখা। গত বছর রহিমুল্লাহ আমাকে জানালেন, তার খুব ইচ্ছা তার চাষের কুল তিনি রাষ্ট্রপতি মহোদয় ও প্রধানমন্ত্রীকে খাওয়াবেন। আমি কি কোনো ব্যবস্থা করতে পারব! আমি বললাম, পাঠান, আমি চেষ্টা করে দেখি।

রহিমুল্লাহ এ মৌসুমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য তার চাষ করা কুল পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। আমি একটা চিঠি যুক্ত করে প্যাকেটজাত কুল পাঠিয়ে দিলাম রাষ্ট্রপতি মহোদয় ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর। এরপর চলে গেল বেশ কিছুদিন। গত ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি আমার হাতে রহিমুল্লাহকে লেখা একটি চিঠি দিলেন। একজন সাধারণ কৃষকের পাঠানো কুল খেয়ে রাষ্ট্রপতি তাকে চিঠি লিখেছেন- এ এক অনন্য বিষয়। এটা রহিমুল্লাহর জন্য নয়, বাংলাদেশের সব কৃষকের জন্য অনুপ্রেরণার। আমি চিঠিটি তৎক্ষণাৎ রহিমুল্লাহর কাছে পৌঁছে দিইনি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও শুরু করেছি প্রাকবাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’। কক্সবাজারের কৃষকের নানা সমস্যার কথা শুনে আসছি কিছুদিন ধরেই। যেমন তামাক চাষের পরিমাণ বাড়ছে দিন দিন। লবণ চাষিরা মূল্য পাচ্ছেন না, মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট ব্যবহার হচ্ছে খাবার লবণ হিসেবে- এসব অভিযোগ শুনে আসছি কয়েক বছর ধরেই। তাই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর একটি পর্ব এ বছর ধারণ করি কক্সবাজারে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় চার হাজার কৃষক। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ বিভিন্ন দফতরের কর্তাব্যক্তি। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে আমি উপস্থিত কৃষকের মাঝে ‘রহিমুল্লাহ’ আছেন কিনা জানতে চাই। হাজার হাজার কৃষকের মাঝে একজন সাধারণ কৃষক উঠে দাঁড়ালেন। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মহামান্য রাষ্ট্রপতির লেখা চিঠিটি। জুনাইদ আহমেদ পলক চিঠিটি উপস্থিত সব কৃষকের সামনে পাঠ করে শোনান।

‘প্রিয় রহিমুল্লাহ, আসসালামু আলাইকুম। শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে আপনার বাগানের বাউকুল প্রেরণের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আপনি একজন কর্মবীর মানুষ। চ্যানেল আইয়ে জনাব শাইখ সিরাজের উপস্থাপনায় “হৃদয়ে মাটি ও মানুষ” অনুষ্ঠান আপনাকে বাউকুল চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে জেনে আমি খুশি হয়েছি। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে আপনি আজ বিশাল বাউকুল বাগানের মালিক হয়েছেন, অর্থনৈতিকভাবে হয়েছেন স্বাবলম্বী। আমার বিশ্বাস আপনার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষ কৃষিপণ্য, ফল ও ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন এবং নিজেদের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন।

জনাব শাইখ সিরাজের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান ইতোমধ্যে দেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে এবং কৃষি উৎপাদনে ইতিবাচক অবদান রাখছে। আমি আশা করি বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে তিনি ভবিষ্যতেও তার উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ অব্যাহত রাখবেন।

আমি নিজেও একজন কৃষকের সন্তান। তাই কৃষকের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা ঠিকই অনুভব করতে পারি। বর্তমান সরকার প্রতিটি “গ্রামকে শহরে পরিণত করা”র যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, আমার বিশ্বাস শিগগিরই আপনারা তার সুফল পাবেন। গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় এ কর্মসূচি নতুন মাত্রা যোগ করবে। আমি আপনার ও আপনার পরিবারের সকলের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও অব্যাহত সাফল্য কামনা করছি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

মো. আবদুল হামিদ।’

যা হাজার হাজার কৃষককে অনুপ্রাণিত করে এবং সেই মুহূর্তটিতে আবেগ, উচ্ছ্বাস আর আনন্দের অন্যরকম এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আবেগাক্রান্ত রহিমুল্লাহর আনন্দের কান্না ছড়িয়ে পড়ে সব কৃষকের চোখে। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের লেখা চিঠিটি রহিমুল্লাহকে হস্তান্তর করার জন্য মঞ্চে ডাকা হয়। তিনি কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে এলেন। জুনাইদ আহমেদ পলক তাকে জড়িয়ে ধরেন। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের একটি শুভেচ্ছা জানানো চিঠি হাজার হাজার কৃষকের মাঝে সঞ্চার করে উদ্দীপনার। প্রতিটি মুখ যেন হয়ে ওঠে সাহসের, নতুন সংকল্পের। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সিলমোহরযুক্ত প্যাডে লেখা চিঠিটি রহিমুল্লাহর হাতে হস্তান্তর করার পর আমি রহিমুল্লাহকে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- আপনি কিছু বলবেন? গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক আবেগঘন ওই মুহূর্তটি সামলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন, ‘আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে সর্বপ্রথম সালাম জানাই- আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে, আমার কক্সবাজার জেলাবাসীর পক্ষ থেকে, আমার সংগ্রামী কৃষক ভাইদের পক্ষ থেকে উনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। মাননীয় রাষ্ট্রপতি আপনাকে ধন্যবাদ।’

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর