শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা

মুফতি এহসানুল হক জিলানী : পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। মানব জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের রয়েছে নিখুঁত নির্দেশনা। মানবসভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা। সমাজ ব্যবস্থা শান্তিময় ও নিরাপদ হলে সেখানে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। সে জন্য ইসলাম সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কথা ও কাজের মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়ে কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাগুলো দিয়ে গিয়েছেন। 

সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হজরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, মুসলমান তাকে বলা হয় যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ।

অপর হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, মুমিন ওই ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে অন্য মানুষের জানমালের ক্ষতির কোনো শঙ্কা না থাকে।

অনেকের ধারণা হলো, দীন কেবল আকিদা, বিশ্বাস, নামাজ, রোজা ও নির্দিষ্ট কিছু ইবাদত-বন্দেগির নাম। এসব ইবাদত-বন্দেগি পালন করার পর মানুষ তার জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে স্বাধীন।

অথচ বাস্তবতা হলো, ইসলাম যেমনিভাবে আমাদের নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, ঠিক সেভাবেই জীবনের প্রতিটি শাখা-প্রশাখাতে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে, যার ওপর আমল করলে আমাদের সমাজ বেহেশতে পরিণত হবে।

অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, ইসলামের শিক্ষার মাত্র এক-চতুর্থাংশ আকিদা-বিশ্বাস এবং ইবাদত-বন্দেগি সংক্রান্ত আর এর বাকি তিন-চতুর্থাংশই হলো শিক্ষা লেনদেন, আখলাক ও সামাজিক বিষয়সংক্রান্ত।

ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ শাখা-প্রশাখার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হলো সামাজিক আচার-আচরণ। যাতে অন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা ও পরস্পর মিলে জীবনযাপনের আদব-শিষ্টাচারের আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের উপরে বর্ণিত হাদিসটিতে রসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের সামনে ইসলামী সমাজব্যবস্থার স্বয়ংসম্পন্ন ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছেন। কেননা, সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলাম যত বিধিবিধান দিয়েছে, তার চূড়ান্ত ও সর্বশেষ উদ্দেশ্য হলো, কোনো মুসলমান যেন অপর কোনো ভাইয়ের কষ্টের কারণ না হয়।

উল্লেখ্য, ইসলাম দেড় হাজার বছর ধরে উদারতা, মানবিক মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করে আসছে। এতে আজ বিশ্বব্যাপী ইসলাম জীবন্ত আদর্শরূপে বহু জাতি-গোষ্ঠী অধ্যুষিত সমাজে নিজের ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করে যে চুক্তি করলেন, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত এ সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। ধর্মীয় ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না। অপরাধের জন্য ব্যক্তি দায়ী হবে, সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না। মদিনা প্রজাতন্ত্রকে পবিত্র ঘোষণা করা হলো। রক্তপাত-জুলুম নিষিদ্ধ করা হলো।’ কোনো ধর্মকে কটাক্ষ, অপমান ও ব্যঙ্গ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ইসলামে জায়েজ নেই। কোনো ইমানদার ব্যক্তি অমুসলিমদের উপাসনালয়ে হামলা করতে পারে না। বিধর্মীদের উপাস্যদের গালি-কটাক্ষ না করার জন্যও মহান আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যেসব উপাস্যের প্রার্থনা করে গালি দিও না। (সূরা আনআম : আয়াত নং ১০৮)

মহানবীর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে অমুসলিমদের উপাসনালয়ে আক্রমণ বা তাদের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এমন কোনো নজির নেই। রাষ্ট্রদ্রোহী সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় এনেছেন। সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম ইসলামে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পূর্ণ মোবারক জিন্দেগি জুড়েই সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। তিনি তরুণ বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের শান্তিসংঘ গঠন করে তিনি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। মানুষের সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, অত্যাচারিতকে সহযোগিতা করা, শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রীয় সম্প্রীতি বজায় রাখা ছিল তাঁর এ শান্তিসংঘের অঙ্গীকার বাণী। মানুষের কল্যাণে তার গড়া স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সাংগঠনিক রীতিতে প্রতিষ্ঠিত। নবুওয়াত লাভের পর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম যেন নতুন উদ্যমতা লাভ করেছিল।

নবুওয়াতি জিন্দেগিতে তাঁর সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার কিছু উদ্যোগ বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল মাইলফলক হয়ে থাকবে। এর মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের দিন মক্কাবাসীদের সাধারণ ক্ষমা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হুদাইবিয়ায় রসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের প্রবল মনোরোষ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও কোরাইশদের সঙ্গে এক অসম চুক্তিতে উপনীত হন। বাহ্যিক পরাজয়মূলক হওয়া সত্ত্বেও কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তিনি এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন।

চুক্তির ছয়টি ধারার প্রতিটি ছিল চরম মানবতাবিরোধী ও বৈষম্যমূলক। চরম অপমানজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ। চুক্তির ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে সামান্য বোধের মানুষের মনেও প্রশ্নের উদয় হওয়ার কথা, হজরত মুহাম্মদ (সা.) কেন এমন চুক্তি স্বাক্ষর করলেন? তিনি তা করেছিলেন শুধুই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।  পরবর্তী অল্প দিনের মধ্যেই ইসলামের বিজয়ের মাধ্যমে এ শান্তি প্রতিষ্ঠার  বিষয়টি বাস্তবরূপ লাভ করে।

সর্বশেষ খবর