ক্লান্তি ও অবসাদ গ্রাস করলেই ঢাকা ছেড়ে তিন-চার দিন বাইরে কাটিয়ে আসা আমার স্বভাব। আমার জন্মভিটা জল-জোছনার শহর, কবিতা ও গানের শহর আড্ডা ও প্রেমের শহর, হাওরের রাজধানী সুনামগঞ্জ চলে যাই। ক্লান্তি দূর করে ফিরে আসি। কখনো জলে ভেসে, কখনো মুষলধারে নেমে আসা বৃষ্টি উপভোগ করে, কখনো বা আসমান ভেড়ে নেমে আসা জোছনায় গা ভিজিয়ে ম্যারাথন আড্ডা দিতে দিতে সব ক্লান্তি ধুয়েমুছে দিয়ে আসি। কখনো দূরের ভ্রমণে নিউইয়র্ক নতুবা লন্ডন শহরে ছুটে যাই। প্রিয়জনদের কারণে সেই শহরগুলো আমার নিজের শহর মনে হয়। এবার লন্ডন গিয়েছিলাম সাত দিনের জন্য। সারা রাত আড্ডা, ভোরের সকালে হোটেলে ফিরে টানা ঘুম। রবিবার সকালে হোটেলে ফিরে গিয়ে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ফেসবুকে চোখ রাখতেই মোহাম্মদ শাহেদের স্ট্যাটাস দেখি। এরশাদ আর নেই। বন্ধু শাহেদকে ফোন করতেই বললেন, সিএমএইচে এই মাত্র এরশাদের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়েছে। তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল পৌনে ৮টা। আমিও একটি স্ট্যাটাস দিই। যাওয়ার আগেই জানতাম যে কোনো সময় লাইফ সাপোর্টে থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনাশাসক এরশাদের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা হতে পারে। যে কোনো মৃত্যু আমার কাছে কখনো আনন্দের হয়নি। চিরশত্রুর মৃত্যুও আমি কখনো কামনা করি না। এরশাদের মৃত্যুসংবাদ আমাকে তৎক্ষণাৎ ব্যথিত করেছে। মনে হয়েছে, দেশ একজন রাষ্ট্রচিন্তার আপাদমস্তক ভদ্রলোককে হারিয়েছে। যিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে চিন্তা করে গেছেন। তার সামর্থ্যরে মধ্যে কাজ করে গেছেন।
১৯৮২ সালের মার্চের প্রথম দিকে সুমামগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ’৭৯ সাল থেকে টানা বিজয়ী ছাত্রলীগের প্যানেল পরাজিত হয়েছিল নিজেদের ভাঙন ও আত্মঘাতী প্রতিহিংসার ছোবলে। কলেজ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের অভিষেক অনুষ্ঠানে  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করলেই যারা প্রতিবাদে সেই অভিষেক প- করে দিতেন তাদের হাতেই সেবার সংসদ চলে যায়। সেবার আমাদের প্যানেলের ভরাডুবি হলেও চারজন মাত্র বিজয়ী হন। আর আমি একটি মাত্র ভোটে পরাজিত হই। ভোট চলাকালে নিজ সংগঠনের একটি অংশের বিশ্বাসঘাতকতার তৎপরতা দেখে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগেই কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চলে আসি। ২৩ মার্চ সুনামগঞ্জে আমরা একটি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলাম। আমাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল সেই সভায় ছাত্রনেতাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ বর্তমান জেলা সভাপতি মতিউর রহমানের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে অনুষ্ঠানে খরচ করতে দিলেন। আর সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও রাকসুর বিজয়ী সাধারণ সম্পাদক খন্দকার জাহাঙ্গীর কবীর রানা অতিথি হলেন। আমি ফিরে এসে তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা সুবীর তালুকদার বাপ্টুর হাতে ৪০০ টাকা দিয়ে বললাম, এটি লিডার দিয়েছেন। ১০০ টাকা পথে আমার খরচ হয়েছে। পঁচাত্তর-উত্তর সেই দুঃসময়ে আমরা অগ্রজদের সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শের জন্য ছাত্র রাজনীতিতে নিরলস পরিশ্রম করেছি। ২৩ মার্চ সফল ছাত্রসভা শেষে রাতে ঘুমুতে গিয়ে সকালে উঠেই শুনি, দেশে সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। বিনা রক্তপাতে বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিরাপদে চলে গেছে। রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ হয়েছে। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেনাশাসক এরশাদের পতনের দাবিতে আমাদের যৌবন উৎসর্গ করেছিলাম আন্দোলন সংগ্রামে মিছিলে মিছিলে। আমাদের নেতাদের নির্দেশ আমরা কোনো হিসাব-নিকাশ ছাড়াই পালনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। গণতন্ত্র মুক্তি ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সেই দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে অসংখ্য কর্মী শহীদ হয়েছেন। ’৮৩ সালের মধ্য-ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছড়িয়েছিল, সেই আন্দোলন বেগবান করতে সুনামগঞ্জে সব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী অকালপ্রয়াত পৌর মেয়র মমিনুল মউজদীনের নেতৃত্বে কি সাহসী সংগ্রামই না আমরা গড়ে তুলেছিলাম। সেই আন্দোলনগুলোয় মনে হতো জীবন যদি বুলেটবিদ্ধ হয়, সে হবে বীরত্বের এবং গভীর দেশপ্রেমের। গণতন্ত্রের জন্য জীবন চলে গেলে চলে যাবে। এমন অনুভূতি নিয়ে কমরেড তাজুল থেকে জননেতা ময়েজউদ্দিন হয়ে ডা. মিলন শহীদ হয়েছেন। ছাত্র মিছিল থেকে গুলিতে নিহত হয়েছেন রাউফুন বসুনিয়া থেকে শাজাহান সিরাজের মতো সাহসী ছাত্রনেতারা। এমনকি গণআন্দোলন থেকে জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেন বুলেটবিদ্ধ হয়ে জীবন দিয়েছেন। মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে কী আছে, ছাত্রসমাজের জন্য ভালো না মন্দ তা বিচার-বিবেচনা পর্যন্ত সেদিন রাজনৈতিক নেতৃত্ব করেননি। আমরাও আবেগের তরীতে রাজপথে ভেসে গিয়ে তার খোঁজ নিইনি। সেই আন্দোলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চার বছরের জায়গায় সাত বছরে গড়িয়েছে। আন্দোলনের দাবানলে বার বার শিক্ষাজীবন পুড়েছে। এমনকি কতবার যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ত্যাগের নির্দেশ এসেছে সে হিসাব এখন আর মনে নেই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করলেই যারা প্রতিবাদে সেই অভিষেক প- করে দিতেন তাদের হাতেই সেবার সংসদ চলে যায়। সেবার আমাদের প্যানেলের ভরাডুবি হলেও চারজন মাত্র বিজয়ী হন। আর আমি একটি মাত্র ভোটে পরাজিত হই। ভোট চলাকালে নিজ সংগঠনের একটি অংশের বিশ্বাসঘাতকতার তৎপরতা দেখে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগেই কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চলে আসি। ২৩ মার্চ সুনামগঞ্জে আমরা একটি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলাম। আমাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল সেই সভায় ছাত্রনেতাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ বর্তমান জেলা সভাপতি মতিউর রহমানের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে অনুষ্ঠানে খরচ করতে দিলেন। আর সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও রাকসুর বিজয়ী সাধারণ সম্পাদক খন্দকার জাহাঙ্গীর কবীর রানা অতিথি হলেন। আমি ফিরে এসে তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা সুবীর তালুকদার বাপ্টুর হাতে ৪০০ টাকা দিয়ে বললাম, এটি লিডার দিয়েছেন। ১০০ টাকা পথে আমার খরচ হয়েছে। পঁচাত্তর-উত্তর সেই দুঃসময়ে আমরা অগ্রজদের সঙ্গে খেয়ে না খেয়ে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শের জন্য ছাত্র রাজনীতিতে নিরলস পরিশ্রম করেছি। ২৩ মার্চ সফল ছাত্রসভা শেষে রাতে ঘুমুতে গিয়ে সকালে উঠেই শুনি, দেশে সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ মার্শাল ল জারি করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। বিনা রক্তপাতে বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিরাপদে চলে গেছে। রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ হয়েছে। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেনাশাসক এরশাদের পতনের দাবিতে আমাদের যৌবন উৎসর্গ করেছিলাম আন্দোলন সংগ্রামে মিছিলে মিছিলে। আমাদের নেতাদের নির্দেশ আমরা কোনো হিসাব-নিকাশ ছাড়াই পালনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। গণতন্ত্র মুক্তি ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সেই দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে অসংখ্য কর্মী শহীদ হয়েছেন। ’৮৩ সালের মধ্য-ফেব্রুয়ারি মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন ছড়িয়েছিল, সেই আন্দোলন বেগবান করতে সুনামগঞ্জে সব ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মী অকালপ্রয়াত পৌর মেয়র মমিনুল মউজদীনের নেতৃত্বে কি সাহসী সংগ্রামই না আমরা গড়ে তুলেছিলাম। সেই আন্দোলনগুলোয় মনে হতো জীবন যদি বুলেটবিদ্ধ হয়, সে হবে বীরত্বের এবং গভীর দেশপ্রেমের। গণতন্ত্রের জন্য জীবন চলে গেলে চলে যাবে। এমন অনুভূতি নিয়ে কমরেড তাজুল থেকে জননেতা ময়েজউদ্দিন হয়ে ডা. মিলন শহীদ হয়েছেন। ছাত্র মিছিল থেকে গুলিতে নিহত হয়েছেন রাউফুন বসুনিয়া থেকে শাজাহান সিরাজের মতো সাহসী ছাত্রনেতারা। এমনকি গণআন্দোলন থেকে জীবন্ত পোস্টার নূর হোসেন বুলেটবিদ্ধ হয়ে জীবন দিয়েছেন। মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে কী আছে, ছাত্রসমাজের জন্য ভালো না মন্দ তা বিচার-বিবেচনা পর্যন্ত সেদিন রাজনৈতিক নেতৃত্ব করেননি। আমরাও আবেগের তরীতে রাজপথে ভেসে গিয়ে তার খোঁজ নিইনি। সেই আন্দোলনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চার বছরের জায়গায় সাত বছরে গড়িয়েছে। আন্দোলনের দাবানলে বার বার শিক্ষাজীবন পুড়েছে। এমনকি কতবার যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল ত্যাগের নির্দেশ এসেছে সে হিসাব এখন আর মনে নেই।
’৯০ সালে ছাত্রসমাজের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিলে একপর্যায়ে এরশাদ পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পদত্যাগের পর তিন জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। তার অধীনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের অধীনে সব দল নির্বাচনী প্রচারণার সমান সুযোগ পেলেও পরবর্তীতে আবেগের বাইরে এসে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টি সমান সুযোগ পাননি। এমনকি এরশাদকে স্ত্রী-সন্তানসহই নয়, নেতাদেরও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অথচ সেই নির্বাচনে কারাবন্দী এরশাদ একাই পাঁচটি আসনে ও তার পার্টি এই বিপর্যয়ের মধ্যে ৩৫টি আসনে জয়লাভ করে। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সংসদীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। এমনকি এরশাদের ছেড়ে দেওয়া আসনে নিজেদের এলাকায় পরাজিত মিজানুর রহমান চৌধুরী ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বিজয়ী হয়ে আসেন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি রণকৌশলগতভাবে এরশাদকে কিছুটা হলেও ছাড় দিত, তাহলে ’৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসত না। ’৯১ সালে নির্বাচনী ফলাফল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আমার পর্যবেক্ষণে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে যেতে এক মোহনায় মিলিত করেছিল হয়তো এ কারণে যে, রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা বহাল থাকলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারাবন্দী এরশাদকে পরাজিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াত। ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক শক্তি আন্দোলনের মুখে সেনা সমর্থন হারিয়ে এরশাদ পদত্যাগ করলেও জনপ্রিয়তা যে হারাননি, তা তাকে এবং তার দলকে ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে টেলিভিশন বক্তৃতা থেকে প্রচারণায় সমঅধিকার না দেওয়ার পরও কারাবন্দী এরশাদ ফের পাঁচটি করে আসনে ও তার দল ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়। এমনকি তার মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু দুটি আসনে বিজয়ী হন। এমনকি বিতর্কিত গোলাম ফারুক অভিও এরশাদের জনপ্রিয়তায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননকে বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে দেন। এরশাদের উপজেলা নির্বাচন প্রতিরোধ করতে গিয়ে আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। অনেকের সঙ্গে আমি নিজেও জেল খেটেছি। কিন্তু দেখেছি, সেই উপজেলা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অনেক যোগ্য মানুষ বিজয়ী হয়েছেন এবং পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে, উপজেলাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা কতটা অনিবার্য ছিল। ’৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি উপজেলাব্যবস্থা তুলে দিলেও ’৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জনগণের চাহিদা থেকে সেটি পুনঃপ্রবর্তন করে। কিন্তু এরশাদের উপজেলা স্থানীয় সরকারে যত শক্তিশালী ছিল, তা আর হয়নি। এরশাদ নির্বাচিত এমপিদের একজন থেকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করেছিলেন। এখন আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের ভোটের ধারায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হচ্ছেন। কিন্তু তাদের মর্যাদা জেলা প্রশাসকের ওপরে না নিচে, তা এখনো ঠিক হয়নি।
কারামুক্তির পর এরশাদের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি করমর্দন করে আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমার হাত এত নরম, কিন্তু তোমার লেখা তো কঠিন ও শক্ত।’ এবার মৃত্যুর আগে হোটেল ওয়েস্টিনে হুইল চেয়ারে করে তিনি এসেছিলেন তার দলের ইফতারে। কিছু সময় ছিলেন। তখন তিনি স্মৃতিশক্তি অনেকটা হারিয়ে ফেলেছেন। তার দলের নেতারা মতিউর রহমান চৌধুরী, নঈম নিজাম ও আমাকে পরিচয় করিযে যখন দেন, তিনি চিনতে পারেন। হেসে বলেছিলেন, ‘ওরে বাপ তার যা লেখা!’ একবার একটি দৈনিকের ঈদ সংখ্যায় আমার একটি লেখা নিয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এরশাদকে চাপ দিলে তিনি মালিককে একটি চিঠিও লিখেছিলেন, যাতে আমার চাকরি চলে যায়। এ বি এম মূসা তখন সেই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মূসা ভাই এরশাদকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন এমন করে যে, অনুজের প্রতি অগ্রজের স্নেহশীল দৃষ্টি থাকাই উচিত। এরশাদ এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি। এমনকি পরবর্তীতে আমার বিভিন্ন লেখা পড়ে তিনি নিয়মিত টেলিফোনে প্রশংসা করতেন। এমনকি একবার একটি চিঠি লিখে যখন তিনি ধন্যবাদ ও প্রশংসা জানালেন, তখন আমি আরেক লেখায় লিখেছিলাম, সাংবাদিকদের আসলে কোনো বন্ধু নেই। তাই একদিন আমার লেখায় এরশাদ যেমন ক্ষুব্ধ হয়ে চিঠি লিখেছিলেন মালিককে তেমনি এরশাদ লেখা পাঠ করে আজ ধন্যবাদ জানিয়ে প্রশংসাসুলভ চিঠি দিয়েছেন। এরশাদের জীবনে সুন্দর দিকগুলোর একটি এ রকমই ছিল। তিনি আবার চিঠি লিখে আমাকে বললেন, ‘পীর হাবিব, তোমার কোনো লেখা পড়ে আনন্দ লাভ করলে যদি আহ বলতে পারি, তাহলে ব্যথিত হলে কি আমি উফ বলতে পারব না?’ তার এই চিঠি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি একজন রোমান্টিক রুচিশীল ও ভদ্র বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তাকে কাছে থেকে দেখেছি, দারুণ চার্মিং পার্সোনালিটি। সেন্স অব হিউমার প্রখর। শিশুদের ভীষণ ভালোবাসতেন। বিদেশ গেলে আমার ছেলের জন্য খেলনা গাড়ি উপহার আনতেন। এরিককে সব সময় কাছে কাছে রাখতেন। প্রায় সন্ধায় তাকে নিয়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে যেতেন। তার একটি কবিমন ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের তিনি পছন্দ করতেন। পড়াশোনাও করতেন নিয়মিত। পরিণত বয়সেও দুই ঘণ্টা জিমে কাটিয়ে গলফ খেলতে যেতেন। অনেক দিন অনেক সন্ধ্যা কখনো একা কখনো বা বন্ধু নঈম নিজামসহ তার সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা দিয়েছি। সুনামগঞ্জে হাওরে তাকে নিয়ে গিয়েছি। শরীরে জ্বর নিয়ে বাউলের গান তিনি শুনেছেন। বসন্ত উৎসবে মাহমুদুর রহমান মান্না ও আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারসহ তাকে নিয়ে গেছি। বক্তৃতার মঞ্চে কবিতা লিখে সেটি পাঠ করে শুনিয়েছেন। বক্তৃতা করেননি। আরেকবার আমার একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে তার সঙ্গে সুনামগঞ্জে নূরে আলম সিদ্দিকী, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, ফজলুর রহমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, নুরুল ফজল বুলবুল, নঈম নিজাম ও বাবরুল হোসেন বাবুলকে একমঞ্চে তুলেছিলাম। তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন।
এরশাদের মৃত্যুতেও দেখেছি অনেকে তার প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ও ঘৃণা ছড়িয়েছেন। এটি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমার বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর খুনি মোশতাক থেকে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান যে নিষ্ঠুর দমননীতি ও হত্যাকা- এবং কারাগারে নিক্ষেপের রাজনৈতিক দমননীতি চালিয়েছিলেন, এরশাদ ততটা করেননি। এরশাদের সময় রাজনৈতিক কর্মীরা যে আন্দোলন সংগ্রাম করতে পেরেছেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য পর্যন্ত যেসব ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক ছিলেন তা পরবর্তীতে আর দেখা যায়নি। এরশাদ বিসিএস পরীক্ষা নিয়োগ থেকে প্রশাসনকে কখনো দলীয়করণ করেননি। শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতায় নিজের ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্রসমাজ’কে বিলুপ্ত করেছিলেন। বিচারব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিতে থানায় থানায় আদালত এবং বড় বড় শহরে হাই কোর্ট স্থাপন করেছিলেন। বড় বড় আইনজীবীর জন্য সেটি আর টিকতে পারেনি। জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে বিসমিল্লাহ জুড়ে ছিলেন। এরশাদ সেখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত করেছিলেন। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী। কিন্তু দুঃখজনক হলো যে, এরশাদকে বিদায় করার পর গণতন্ত্রের নেতারা বার বার ক্ষমতায় এসেও সেটি আর পরিবর্তন করেননি। রংপুরে এরশাদের জানাজায় লাখো মানুষ হয়েছে। জীবনেও রংপুর পাশে ছিল। মরণেও রংপুর পাশে থাকল। সেখানে জনগণের দাবিতে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এরশাদের সকল দুঃসময়ে পাশে থাকা তার স্ত্রী রওশন এরশাদও সেখানে তার কবর রাখার কথা বলেছেন। এরশাদের জীবন যত বর্ণাঢ্য ও আলোচিত হোক না কেন, রওশনের প্রতি কখনো তাকে শ্রদ্ধা হারিয়ে কথা বলতে দেখিনি। ভাইবোনদের প্রতি ছিল তার গভীর স্নেহ। অতিথিদের তিনি ভীষণ সম্মান করতেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে, এ দেশের রাজনীতিতে এরশাদকে সব দলের নেতারাও কঠিন, কঠোর বাক্যে আক্রমণ করলেও এরশাদ কখনো শালীনতার পর্দা সরিয়ে বক্তৃতার মঞ্চে কাউকে আঘাত করে কথা বলতেন না। অনেক মামলা নিয়ে তিনি মরেছেন। মামলাগুলো কোনো সরকারই শেষ হতে দেয়নি। তার অন্যতম কারণ হতে পারে, যার অনেকটাই ছিল রাজনৈতিক মামলা। দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তার সঙ্গে ঐক্যের মঞ্চে উঠেছেন ড. কামাল হোসেন ছাড়া। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এরশাদের অবদানকে শোকবার্তায় উল্লেখ করেছেন। তার সঙ্গে যদি ক্ষমতার রাজনীতিতে সব নেতা ঐক্যের বৈঠক করতে পারেন, তাহলে তার লাশ দেখতে বা জানাজায় শোক জানাতে কেন গেলেন না বুঝিনি। এরশাদ এ দেশের ওষুধ শিল্প থেকে গার্মেন্ট শিল্প এবং যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। দেশের উন্নয়নে তার কর্মকা- অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেকে বলেন, তিনি সকালে একটা বিকালে আরেকটা বলতেন। মামলায় মামলায় হাত-পা বেঁধে তাকে রাজনীতিতে সাঁতার কাটতে দেওয়া হয়েছিল বলে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করে যেতে পারেননি। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তার সমর্থন সংসদে রেখেই যাননি, সেনাশাসক হয়ে মরেননি, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে পাঁচ পাঁচটি আসনে কারাগারে বসে জয়ী হয়ে গণতন্ত্রের নেতা হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এরশাদকে যে স্বপ্ন নিয়ে জনগণ ক্ষমতা থেকে নামিয়েছিল সে স্বপ্ন কি বাস্তবায়ন হয়েছে? এরশাদকে দুর্নীতির বরপুত্র বলা হতো। পরবর্তী গণতন্ত্রের শাসনামলে একের পর এক ঘটে যাওয়া দুর্নীতির সামনে এরশাদকে কি শিশুর মতো মনে হয়নি?
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        