বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

চলে গেলেন হাসান জামিল সাত্তার

দুলাল আচার্য

চলে গেলেন হাসান জামিল সাত্তার

না-ফেরার দেশে চলে গেলেন শত-সহস্র কর্মীর প্রিয় ‘দাদা’ হাসান জামিল সাত্তার। ভক্তদের কাছে রাজনীতির শুদ্ধপুরুষ তিনি। দাউদকান্দির রাজনীতিসচেতন মানুষের কাছে সজ্জন ব্যক্তি। গত বৃহস্পতিবার মহামারী করোনাভাইরাসের কাছে হার মানেন, নীতির প্রশ্নে হার না মানা এই রাজনীতিক। হাসান জামিল সাত্তার কুমিল্লার ময়নামতি টেক্সটাইল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন যুক্ত। ছিলেন কেন্দ্রীয় বঙ্গমাতা পরিষদের উপদেষ্টা। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার  মোশাররফ হোসেন, রাজনীতিবিদ বাদল রায়, দাউদকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোহাম্মদ আলী সুমনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীলসমাজের নেতা। হাসান জামিল সাত্তার রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা বিশিষ্ট সমাজসেবী-দানবীর আবদুস সামাদ সরকার মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তিনি এবং তাঁর পরিবার বহু মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও সংখ্যালঘু পরিবারের নানাভাবে জীবন রক্ষা করেছেন। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পর দাউদকান্দির হাসানপুরে শহীদ নজরুলের নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম এখন হাসানপুর শহীদ নজরুল সরকারি ডিগ্রি কলেজ। আমি গর্বিত এ কারণে, শহীদ নজরুল আমার গ্রামের বীর সন্তান। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ নজরুল ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন এবং ’৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। সাত্তার সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৮৮ সালে হাসানপুর কলেজে। আমি তখন ওই কলেজের ছাত্র। তারিখটা মনে নেই, এক বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা ও সদ্যবিদায়ী কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল আউয়াল সরকার উপস্থিত ছিলেন। বহু শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে হাসান জামিল সাহেব বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্যে একপর্যায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে প্রশংসা করে তাঁর ত্যাগ ও সংগ্রামী জীবনের নানা দিকের আলোচনা আমাদের আবেগময় করে তুলেছিল। বক্তব্য শোনার পর আমি ভেবেছিলাম তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। পরে জেনেছি তখনো তিনি সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতিতে আসেননি।

হাসান জামিল সাত্তার দাউদকান্দি থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি ও ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং বেহাল আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন। সেবার জনমত জরিপে হাসান জামিল সাত্তার বিজয়ের কাছাকাছি ছিলেন। কথিত আছে, আগেই এ আসনে ফলাফল নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের দিন প্রথমে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া এবং পরে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ সব দল নির্বাচন বর্জন করে। ২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া জুরানপুরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুল দিয়ে দলে যোগদান করেন। সেই যোগদান অনুষ্ঠানে হাসান জামিল সাত্তারও নেত্রীর পাশে উপস্থিত ছিলেন। তারপর তাঁকে দাউদকান্দির প্রকাশ্য রাজনীতিতে দেখা যায়নি। স্থানীয় রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যান তিনি। তবে কেন্দ্রীয় রাজনীতির ছোঁয়া রাজনীতিপাগল এ মানুষটিকে রাজপথে নামিয়ে আনে। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি হরতাল-মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে রাজপথে সোচ্চার ছিলেন। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার দিনও দলের মিছিল-পূর্ব সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন তিনি। শুনেছি, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করলেও চেতনায় আওয়ামী ধারার ছিলেন অনেক আগে থেকেই। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগের কথা। নেত্রী তখন মুক্ত। আমি সাংবাদিকতার পাশাপাশি মেজর জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভূইয়ার প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছিলাম। অফিস শেষে তাঁর মহাখালীর ডিওএইচএসর বাসায় কাজ করি। দাউদকান্দির ছোট ভাই ছাত্রলীগের রুবেল (সাহাপাড়া) সন্ধ্যায় মহাখালীতে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। কথাবার্তার একপর্যায়ে বলল, দাদা চলেন একজনের বাসায় যাব। বললাম কোথায়? কার বাসায়? বলল চলেন না! সেদিন কাজ ছিল না তাই বেরিয়ে পড়লাম। বনানীর একটি গলিতে ঢোকার মুখে বললাম, রুবেল কার বাসায় যাব বললে না তো। সে বলল, সাত্তার সাহেবের বাসায়। আমি রিকশা থামালাম, বললাম রুবেল আমি যাব না। বললাম আমি সুবিদ আলী ভূইয়ার লোক জানতে পারলে...। রুবেল বলল, দাদা চলেনই না, পরিচয় দেব না। নানা ইতস্তত, পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যাব তবে পরিচয় দেব না। বাসায় একটি রুমে বসলাম। ৫ মিনিট পর তিনি এলেন। দেখলাম রুবেল তার খুবই পরিচিত। নানা কথার ফাঁকে আমার প্রসঙ্গ এলো। নাম শুনেই বুঝলেন আমি কে? প্রশ্ন করলেন জেনারেল সাহেব কেমন আছেন? আমি বললাম ভালো আছেন। খুব পরিশ্রম করছেন মনে হয়, লেখালেখিও করছেন। আমি বললাম জি, সারা দিনই লোকজন সামলাচ্ছেন। রুবেল সাত্তার সাহেবকে বলল, এবার মনোনয়ন চাইবেন না? দল তো প্রার্থী নির্ধারণ করবে। মৃদু হেসে বললেন, ক্যান্ডিডেট তো ঠিক হয়েই আছে। শুধু শুধু...। আর আমি তো আওয়ামী লীগেই আছি। রুবেল বলল, মাঠে নামবেন না? দাউদকান্দিতে আপনার অনেক নেতা-কর্মী। বললেন, সবাই তো মাঠেই আছে, তোমরা মাঠে আছো না? আমার কি প্রয়োজন আছে মাঠে নামার? একপর্যায়ে ভাবি এলেন, আপ্যায়ন করলেন।

আসলে মৃত্যু মানুষের অনিবার্য নিয়তি। একদিন মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে। প্রকৃতির নিয়মের ব্যত্যয় কারও ক্ষেত্রেই ঘটবে না। হাসান জামিল সাত্তারও তেমনি একজন। মানুষ বাঁচে তার কর্মে, তার সেবায়। হাসান জামিল সাত্তারও বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে শত-সহস্র নেতা-কর্মীর ভালোবাসার মাঝে। মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে যা তিনি শিখিয়েছেন তা আমরা কর্মীরা কখনোই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তাঁর কাছে শিখেছি। তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন- এ প্রার্থনা রইল।

লেখক : সহকারী সম্পাদক (প্রকাশনা) প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

সর্বশেষ খবর