আমি প্রথম সাকিব আল হাসানের ক্ষমা চাওয়ার ভিডিওটি দেখেছি, কয়েক ঘণ্টা পর পেলাম সাকিবকে খুন করার হুমকি দেওয়া ভিডিও। এই দুটো ভিডিও দেখে দেশের পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। কেন লোকেরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না, একেবারে খুন করার পরিকল্পনা করে ফেলে। আর কেনই বা এদের কাছে নমস্যদের ক্ষমা চাইতে হয়।। সাকিব নাস্তিক নন, রীতিমতো আস্তিক। সাকিব হিন্দু নন, বৌদ্ধ নন, খ্রিস্টান নন, ইহুদি নন, তিনি একজন গর্বিত মুসলমান, হজ পর্যন্ত করে এসেছেন। তা হলে তাঁকে কেন টার্গেট করা হলো? এ সময় আমার মনে পড়ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যাওয়ার পর নাৎসিদের অত্যাচার এবং বুদ্ধিজীবীদের স্বার্থপরতা নিয়ে জার্মান প্যাস্টর মার্টিন নিমোলারের সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি- ‘’প্রথমে ওরা কম্যুনিস্টদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি কম্যুনিস্ট নই।
তারপর ওরা সোশ্যালিস্টদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি সোশ্যালিস্ট নই।
তারপর ওরা ট্রেড ইউনিওনিস্টদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি ট্রেড ইউনিওনিস্ট নই।তারপর ওরা ইহুদিদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি ইহুদি নই।
তারপর ওরা আমার জন্য এলো, তখন কেউ আর ছিল না প্রতিবাদ করার।‘’
ঠিক এরকম করে বলা যায়,
‘’প্রথমে ওরা হিন্দুদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি হিন্দু নই।
তারপর ওরা বৌদ্ধদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি বৌদ্ধ নই।
তারপর ওরা খ্রিস্টানদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি খ্রিস্টান নই।
তারপর ওরা নাস্তিকদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি নাস্তিক নই।
তারপর ওরা মুক্তচিন্তকদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি মুক্তচিন্তক নই।
তারপর ওরা সমকামীদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি সমকামী নই।
তারপর ওরা নামাজ-রোজা-না-করা-মুসলমানদের জন্য এলো, আমি প্রতিবাদ করিনি, কারণ আমি নামাজ-রোজা-না-করা-মুসলমান নই।
তারপর ওরা যখন আমার জন্য অর্থাৎ সাচ্চা মুসলমানদের জন্য এলো, তখন মাথা নুইয়ে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না।‘’
যদি আজকে কেউ ওরকম লম্বা রাম’দা দেখিয়ে বলতো, সাকিবকে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিতে হবে, তা না হলে তাঁকে কুচি কুচি করে কেটে ফেলবো। তাহলে কি সাকিব খেলা ছেড়ে দেবেন? দেবেন না। কেউ যদি কোনও মন্ত্রীকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, কাউকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয় বা কাউকে চাকরি বাকরি ব্যবসাপাতি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, তাহলে কি কেউ কিছু ছেড়ে দেবেন? দেবেন না। কিন্তু কেউ যদি বলে আমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিস, তোর আর রক্ষে নেই, তখন সবাই পড়ি কী মরি করে ক্ষমা চাওয়া, যাবতীয় কিছু ত্যাগ করা, দেশান্তরি হওয়া- সব করতে রাজি। কেন? কারণ দিনে দিনে বাংলাদেশে পঙ্গপালের মতো বেড়েছে অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি করা বা ব্যবসা করার লোকদের সংখ্যা। এরা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত এই অজুহাতে যে কাউকে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে। আমরা গত কয়েক বছরে এই নৃশংস হত্যাকা-গুলো দেখেছি। কত প্রতিভাবান মুক্তচিন্তকদের রক্তে লাল হয়েছে বাংলাদেশের রাজপথ! সমাজের মাথারা, রাষ্ট্রের সেবকরা, দেশের শাসকেরা তখন অনুভূতিওয়ালাদের দোষ না দিয়ে দোষ দিয়েছেন মুক্তচিন্তকদের, কেন তারা মুক্তচিন্তা করতে গেল, কেন অন্যের অনুভূতিতে আঘাত দিল। তখন তো অনুভূতি-ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো।
তারা দিনরাত যুবসমাজকে হিংসে, ঘৃণা আর কুবুদ্ধি দিয়ে মগজধোলাই করছে। মগজধোলাইয়ের কাজ প্রকাশ্য দিবালোকেই করে, লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করতে হয় না। মগজধোলাই করার লাইসেন্স তারা বৈধভাবেই পেয়েছে।
কোথায় আজ উদারনৈতিক ইসলাম? ধীরে ধীরে সেটি বিলুপ্ত হচ্ছে বাংলাদশে। সে কারণে সুফি মতবাদের ওপর, বাউল ফকিরদের ওপর হুমকি আসে। উদারনৈতিক ইসলামকে হটিয়ে দিয়ে আনা হয়েছে সালাফিদের কট্টরপন্থি ইসলামকে, যে ইসলামে বিশ্বাস আইসিস, আল কায়দা, আল শাবাব, বোকো হারামের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর।
মহসিন তালুকদারকে কে বা কারা জিহাদি বানিয়েছে তা তার ভয়াবহ কুৎসিত বীভৎস বিবৃতিতেই স্পষ্ট। দুজন ওয়াজ-ব্যবসায়ীর নাম সে উল্লেখ করেছে। ওয়াজ-ব্যবসায়ীরা তো সরকারের দেওয়া ছাড়পত্র নিয়েই শহরে নগরে গ্রামেগঞ্জে যুবসমাজকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে।
তাহলে মহসিন তালুকদারকে কারা তৈরি করেছে, এ ব্যাপারে আমাদের নিশ্চয়ই ধারণা জন্মেছে। সাকিবের মতো সাচ্চা মুসলমানকে আজ জিহাদিদের আদেশ অনুযায়ী ক্ষমা ভিক্ষে চেয়ে বাংলাদেশে বাস করতে হয়। এই বাংলাদেশকে দেখলে বিশ্বাস হয় না যে লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বুকে নিয়ে একদিন এর জন্ম হয়েছিল। মহসিন বলেছে, সে মরে যাবে এতে তার আপত্তি নেই, কিন্তু তার অনুভূতিতে যে আঘাত করেছে, তাকে মেরে মরবে। ধর্মের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করলে যে পরকালে জান্নাত মিলবে, এও তাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ কারণে অনুভূতিতে আঘাত লাগার ছুতোয় তারা রাম’দা, চাপাতি, তলোয়ার, বোমা কিছুই হাতে নিতে দ্বিধা করে না।
প্রকৃত শিক্ষা থেকে শিশু-কিশোর আর যুবসমাজকে বঞ্চিত করছে বাংলাদেশ। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনও ধারণা না নিয়ে বড় হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সাকিব আল হাসানকে আজ মাথা নোয়াতে হতো না যদি আজ দেশের মানুষ গণতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতায়, অসাম্প্রদায়িকতায়, বাক-স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করতো। সাকিবের পরাজয় উদারপন্থার পরাজয়। এই দেশের মানুষকে অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক, উগ্র, মূর্খ বানাবার দায় বিভিন্ন সরকারের, এবং সেই সাথে বুদ্ধিজীবী নামক লোকদের নীরবতার। সাকিবকে আজ জবাবদিহি করতে হয় কেন তিনি ম-পে গিয়েছিলেন, কেন তিনি পূজা উদ্বোধন করেছেন। সাকিব আজ বলতে পারেননি তিনি কী করবেন, কী খাবেন, কী পরবেন, কোথায় যাবেন, কী উদ্বোধন করবেন, কী বিশ্বাস করবেন, কতটুকু বিশ্বাস করবেন... সব তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই ব্যক্তি-স্বাধীনতা যদি না থাকে, তবে গণতন্ত্র বলে কিছু থাকে না। সভ্য হওয়ার জন্য গণতন্ত্র প্রথম পদক্ষেপ।
উগ্রবাদকে আশ্রয় দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিরবধি খুঁড়ে চলেছে সহনশীলতার কবর। সে কি আর আজ থেকে! এর সমাধান কী, তা ভাবতে হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী সরকারকে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার স্থূল স্বার্থে যারা উগ্রবাদীদের মদদ দিয়েছেন, তাদেরই দূরদৃষ্টিহীন সিদ্ধান্তে দেশ আজ উগ্রবাদীদের খপ্পরে। এই ভয়ঙ্কর অপশক্তিই আজ সমাজের নিয়ন্ত্রক। সে কারণে মহসিন তালুকদারকে বন্দী করা যায়, কিন্তু দেশের সর্বত্র বিরাজমান অসংখ্য অজস্র মহসিনি-মানসিকতাকে বন্দী করা যায় না। এক একটি মহসিনি-মানসিকতা থেকে লক্ষ মহসিন জন্ম নেবে। যেটুকু গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে, সেটুকু উড়ে যেতে বেশি দিন নেই। সাকিবের মতো সবাইকে তখন নাকে খত দিয়ে, করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষে চেয়ে, কী করেছে, কী খেয়েছে, কী পরেছে, কোথায় গিয়েছে, কী ছুঁয়েছে, কী বিশ্বাস করেছে, তার ফিরিস্তি দিয়ে, তলোয়ারের তলায় গর্দান রেখে বাঁচতে হবে। যাদের তলোয়ার, তাদের বিশ্বাসের চেয়ে তোমার বিশ্বাস কিছু অন্যরকম হয়েছে তো সর্বনাশ, তাদের আদেশের সামান্য অমান্য হলো তো সর্বনাশ, গর্দান কাটা পড়বে।
বাংলাদেশের এই পরিণতি কেন? কারা এর জন্য দায়ী? যারা দায়ী তাদের ভুল সংশোধন করতে হবে। উগ্রবাদের বীজ যাদের সবুজ সংকেত পেয়ে মগজে মগজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদেরই এখন মগজে মগজে গিয়ে বীজ সরিয়ে ফেলতে হবে। সাকিবের মতো আর কাউকে, কোনও হিন্দুকে বা কোনও মুসলমানকে, কোনও বিখ্যাতকে বা অখ্যাতকে যেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদের কোনও অসাম্প্রদায়িক কাজের জন্য, সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখার জন্য, সৌহার্দ আর সমমর্মিতা, সমতা আর সমানাধিকারকে সম্মান জানানোর জন্য ক্ষমা চাইতে না হয়। আর যেন কাউকে কোনও অসহিষ্ণু শক্তির সামনে মাথা নত করতে না হয়।
এত হতাশা চারদিকে, তারপরও শুভদিনের আশায় বসে থাকি।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।