বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বসন্ত উৎসব ও বাঙালির নববর্ষ

নাফিসা বানু

বসন্ত উৎসব ও বাঙালির নববর্ষ

বাংলা বছরের ১১ ও ১২তম মাস ফাল্গুন ও চৈত্র। এ দুই মাস মিলে আমাদের ষড়ঋতুর শেষ ঋতু বসন্ত। শীতের পর বসন্তের আগমন অর্থাৎ ফাল্গুনের শুরু। ফাল্গুনকে প্রতি বছর বরণ করে নেওয়ার জন্য আমরা উদ্গ্রীব থাকি। আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বসন্তকে বরণ করে থাকি ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে...।’ বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আমাদের দেশে বিশেষ উৎসব ও আয়োজনের সঙ্গে পয়লা ফাল্গুন পালন করা হয়। বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ দিনটিকে বরণ করতে চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতি বছর জাতীয় বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে। বাংলার এ অঞ্চলে প্রাচীন আমল থেকেই বসন্ত উৎসব পালিত হয়ে আসছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলোয় এ উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈষ্ণবরা এ উৎসবটি বেশ উৎসাহ ও আয়োজনের সঙ্গে পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশেষ নাচ-গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি প্রচলিত আছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সনে বাংলাদেশে বসন্ত উৎসব উদ্যাপনের রীতি প্রচলিত হয় এবং তখন থেকেই জাতীয় বসন্ত উদ্যাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব পালনের নিয়মিত আয়োজন করে আসছে।

কোকিলের সুমধুর কুহুকুহু ডাকে জানিয়ে দেয় বসন্ত এসে গেছে। সাধারণত যে এলাকায় গাছগাছালি বেশি সেখানে কোকিলের কুহুতানেই সকালের ঘুম ভাঙে। বসন্ত ঋতুকে ‘ঋতুরাজ’ বলা হয়। বসন্ত ঋতুই সব ঋতুর সেরা। এ সময় আবহাওয়া খুব নির্মল থাকে। শীতের শেষে বসন্তকালের শেষ দিকে গরম পড়লেও হালকা মিষ্টিমধুর বাতাস বয়ে যায়, সেই ঝিরিঝিরি বাতাসে ফাগুন হাওয়ায় বেশ সুন্দর একটি মিষ্টিমধুর আমেজের ছোঁয়া অনুভব করে সবাই। এ সময় ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতির সবুজ অঙ্গন। শীতের শেষে অর্থাৎ মাঘের শেষ থেকে গাছে গাছে আমের মুকুলের সমাহার দেখা যায়। মুকুলের ম-ম গন্ধে চারদিকে এক মধুময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, পলাশ, শিমুল ইত্যাদি ফুলে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুলের আগুনরাঙা লাল রঙে আর রাধাচূড়ার হলুদ রঙে প্রকৃতি অপরূপ রূপে সেজে ওঠে। মৃদুমন্দ বাতাসে নানান ফুলের গন্ধ জানান দিয়ে যায় বসন্তের আগমন, শুকনো পাতা ঝরে গিয়ে জন্ম নেয় কচি কচি নতুন পাতা। গাইতে ইচ্ছা করে আহা আজি এ বসন্তে/এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়...’। বসন্ত উৎসবে অর্থাৎ পয়লা ফাল্গুনে ছোট-বড় সব বয়সের মেয়ে হলুদ বা বাসন্তি রঙের জামাকাপড় বা শাড়ি পরে, দেখতে কি ভালোই না লাগে। ফুলের দোকানগুলোয় কেনাবেচার ধুম লেগে যায়। নানা বয়সী মেয়ের মাথায়, হাতে, গলায় থাকে নানা বর্ণের ফুলের অলঙ্কার। ছেলেরাও অনেকে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে নিজেদের সাজায়। দেশে বসন্ত উৎসবটি খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করা হয়। ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে এ উৎসবটি পালিত হয় আমাদের দেশে।

ঋতুরাজ বসন্ত শেষে শুরু হয় গ্রীষ¥কাল। বাংলা বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল। বাংলা বছর অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয় বৈশাখের ১ তারিখ। এ উৎসবের একটি ইতিহাস আছে। মুঘল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালের নতুন বছরকে কেন্দ্র করে। এ ছাড়া তিনি ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন। এর অন্যতম পয়লা বৈশাখ। একটা সময় ছিল যখন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ বলতে কিছুই ছিল না। প্রথমে ফসলি সন পরে বাংলা বর্ষ নামে বঙ্গাব্দ শুরু হয়। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা করা হয় ১৫৮৫ সালে। সম্রাট আকবরের নির্দেশে তৎকালীন নামকরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাংলাভাষী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি প্রথম বাংলা বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। তিনি এটি তৈরি করেন সৌর সন আর তখনকার সময়ের প্রচলিত হিজরি সনের ভিত্তিতে। হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে খাজনা আদায়ের প্রচলন ছিল তখন। তিনি যখন দেখলেন চাঁদের হিসাব করা হিজরি সনের কারণে ফসলের মৌসুমভিত্তিক খাজনা আদায়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় তখনই তিনি নতুন কিছুর চিন্তা করেন। এ চিন্তার ফসলই বাংলা বর্ষ গণনা। উল্লেখ্য, চাঁদের হিসাবে বছর গণনা করা হলে বছরের হিসাব ১১ দিনের একটি গরমিলের ঝামেলায় পড়ে যায়। ফলে বছর বছর ফসলের মৌসুমের সঙ্গে মাসের হিসাব মেলে না। এ অবস্থায় কৃষক এক মৌসুমের খাজনা অন্য মৌসুমে দিতে পারেন না। এ সমস্যার সমাধান হয় বাংলা বর্ষ প্রবর্তনের মাধ্যমে। সম্রাট আকবরের আমলে প্রবর্তিত হওয়ায় তখনই বাংলা ভূখণ্ডে নববর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৬৬ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে পুরনো বাংলা দিনপঞ্জি সংশোধন করা হয়। এখানে প্রথম ছয় মাস ৩১ দিন করে আর কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও চৈত্র ৩০ দিন এবং ফাল্গুন ২৯ দিন করে গণনা করা হয়। প্রতি অধিবর্ষে ফাল্গুনকে ৩০ দিন ধার্য করা হয়। বাংলাদেশে প্রতি নববর্ষ ১৪ এপ্রিলই পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ পালিত হয়। এ দিনটিতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটি।

আমাদের দেশের বর্তমান সরকার কর্তৃক ঘোষিত বৈশাখী ভাতা প্রদানের ফলে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য বৈশাখ উদ্যাপন আনন্দময় ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পয়লা বৈশাখ। পৃথিবীর যত দেশে বাঙালির বসবাস রয়েছে সেখানেই পালিত হয় পয়লা বৈশাখ। আমাদের দেশে ঈদ বা পূজা অনুষ্ঠানের চেয়েও বেশি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পয়লা বৈশাখ। কারণ ঈদ উৎসব পালন করেন মুসলমান জনগোষ্ঠী আর পূজা হলো হিন্দুদের উৎসব, বড়দিন খ্রিস্টধর্মের উৎসব, কিন্তু পয়লা বৈশাখ পালিত হয় ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে। তাই নববর্ষের প্রথম প্রহরে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এসো হে বৈশাখ এসো এসো ...’। রাজধানী ঢাকায় পয়লা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানটি ছায়ানটের সংগীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়। পয়লা বৈশাখের সূর্যোদয়ের পরপরই ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে বর্ষবরণের গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। বর্ষবরণের এ সংগীত অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর ঢাকার রমনা পার্কে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠিত হয়। স্থানটিকে বটমূল বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের নিচে মঞ্চ তৈরি হয় সেটি আসলে অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানিদের নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এ বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এ ছাড়া ঢাকায় বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক রীতি হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি শুরু হয় ১৯৮৭ সালে শিল্পী মাহবুব জামাল শামিম আর হিরণ¥য় চন্দ্রের উদ্যোগে। ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে নিয়মিতভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে আসছে। এ শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন ও আবহমান বাংলার রূপকে ফুটিয়ে তোলা হয়। হাতি, ঘোড়া আর পশু-পাখি ইত্যাদির প্রতিকৃতি দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা সাজানো হয়। শোভাযাত্রা চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসেই শেষ হয়। এ শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশা ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঢাকা বিশ¡বিদ্যালয় আয়োজিত এ উৎসব শোভাযাত্রাকে মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে।

নববর্ষ মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি  কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় নববর্ষ পয়লা বৈশাখ। মেলায় থাকে রকমারি আয়োজনের সমাহার। যেমন পুতুলনাচ, হাতি-ঘোড়ার চরকি, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা, নাগরদোলা, সার্কাস, কীর্তনের আসর। নদীতে নৌকাবাইচ আর মাঠে কুস্তি খেলা। দোকান সাজিয়ে বসে মৌসুমি দোকানিরা। এসব দোকানে থাকে নানারকমের গ্রামীণ জনপদের তৈরি পিঠা, গুড়ের বাতাসা, কদমা, জিলাপি, রঙিন লেবনচুস, মুড়কি, মোয়া, হাওয়াই মিঠাই। আরও থাকে মাটির বাসন-কোসন, কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী, বেলোয়ারি ও রেশমি চুড়ি। আরও হরেকরকম পণ্য। অনেক স্থানে মাটির বাসন-কোসনে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার আয়োজন থাকে। এ ছাড়া এ দিনটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হালখাতা তৈরি বা খোলা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাবের বই বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকার সব স্থানে পুরনো বছরের হিসাবের বই বন্ধ করে নতুন হিসাবের বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এ রীতিটি সোনার দোকানগুলোয় এখনো প্রচলিত আছে।

গ্রীষ্মকালের দ্বিতীয় মাস জ্যৈষ্ঠকে আমরা মধুমাস বলি। এ মাসে বিভিন্ন ধরনের রসালো ফল পাওয়া যায় যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, আনারস ইত্যাদি। গ্রীষ্মকালে খরা ও রোদের তাপ থাকে প্রচণ্ড কিন্তু এ সময়ে রসালো ফল প্রচুর পাওয়া যায়। মানুষ রসালো ফল গ্রহণের মাধ্যমে দাবদাহ থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পায়। এ ছাড়া গ্রীষ্মের শুরুতে বৈশাখে হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝড়ের তাণ্ডবনৃত্য শুরু হয়ে যায়। তার আগে ধূলিঝড় ওঠে। এ সময় গাছ থেকে কাঁচা আম ঝরে পড়ে ঝড়ের তাণ্ডবে। ছেলেমেয়েরা সেই কাঁচা আম কুড়াতে থাকে আনন্দের সঙ্গে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। গাইতে ইচ্ছা হয় আম-কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল’। এবার নববর্ষ ঘরে বসেই উদ্যাপন করতে হবে। করোনা মহামারীর সময় সব গ্লানি ধুয়েমুছে নতুন বছর আমাদের জন্য বয়ে আনুক সুস্থ-সুন্দর স্বাভাবিক জীবন এ কামনা রইল। বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক/এসো হে বৈশাখ এসো এসো...।

লেখক : সদস্য (অর্থ), নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর