শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১১ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

প্রতারণার মামলায় শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায়!

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

প্রতারণার মামলায় শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায়!

আপনারা নিশ্চয়ই ৪২০ বা ‘ফোর টোয়েন্টি’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত। যিনি প্রতারক বা প্রতারণার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাকেই সাধারণত এ নামে ডাকা বা অপবাদ দেওয়া হয়। দন্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রতারণার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ছলনা, প্রবঞ্চনা বা অসাধু উপায়ে অন্যের সম্পত্তি হস্তান্তরে প্রবৃত্ত করে এমনকি অন্যের অনুকূলে প্রদানে প্ররোচিত করে তবে সে ব্যক্তি প্রতারণা করেছে বলে গণ্য হবে।

আবার যদি কোনো ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন প্ররোচনা করা হয় যে ওই প্ররোচনার ফলে সে ব্যক্তির দেহ মন খ্যাতি বা সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে বা ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রতারণার কিন্তু রকমফেরও আছে। যেমন ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা, জালিয়াতি করে প্রতারণা, মিথ্যা পরিচয় প্রদান করে প্রতারণা, বিয়ে নিয়ে প্রতারণা প্রভৃতি। আলাদা প্রতারণার অভিযোগে আলাদা শাস্তি নির্ধারিত আছে। সাধারণত দন্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা বেশি হতে দেখা যায়। এ ধারায় শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর। পাশাপাশি অর্থদন্ডেরও বিধান আছে।

যে কোনো কারণে প্রতারণার শিকার হলে কিংবা চাকরির নামে কোনো প্রতারণার শিকার হলে আইনের আশ্রয় খুব সহজেই নিতে পারেন। আপনি দায়ী ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করতে পারেন। প্রতারণার পাশাপাশি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগও আনা যায়। ক্ষেত্রবিশেষ দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। তবে আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে যথেষ্ট প্রমাণ থাকা লাগবে। যেমন কোনো লিখিত চুক্তি, কোনো রসিদ এসব। তাই এ দলিলগুলো সংরক্ষণ রাখা জরুরি।

বিয়ের নামে যদি কেউ প্রতারণামূলকভাবে সংসার করে, এ ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে। দেশ-বিদেশে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ার সময় টাকা লেনদেন-সংক্রান্ত চুক্তি ভঙ্গ করলেও প্রতারণার অভিযোগ আনা যাবে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। কথা ছিল সুমনকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে আমেরিকা পাঠাবে। চুক্তির শর্তানুযায়ী সুমনের বাবার প্রতিষ্ঠানটিকে তিনটি সমান কিস্তিতে টাকা পরিশোধের কথা। যদি ব্যর্থ হয় তাহলে প্রদেয় টাকা কোনোরকম কর্তন ছাড়াই পরিশোধ করবেন বলে স্বীকার করে দুই পক্ষই স্বাক্ষর করেন। শেষ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি বৃত্তির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়।

সুমনের বাবা তাঁর দেওয়া টাকা ফেরত চান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন, ‘আমরা চুক্তিতে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলেছি। কত দিনের মধ্যে ফেরত দেব তা কিন্তু উল্লেখ নেই।’ তাঁর মতে এটা হতে পারে ছয় মাস, এক বছর বা যে কোনো দিন। তাঁরা তো বলেননি পরিশোধিত পুরো টাকা তাঁরা এক কিস্তিতে পরিশোধ করবেন। তাই তাঁরা যখন যে টাকার ব্যবস্থা করবেন, সুমনের বাবাকে তাই নিতে হবে। এ রকম ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা কাজে লিখিত বা মৌখিকভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ হই। ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পত্তি হস্তান্তর, দান, বিনিময়, সম্পত্তি বিক্রি এমনকি বিয়েতেও চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। কারণ চুক্তিই আইনত গ্রহণযোগ্য। ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের ২(জ) ধারায় চুক্তির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য সম্মতিকে চুক্তি বলে। চুক্তি লিখিত বা মৌখিক উভয় রকমই হতে পারে। আদালত প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে। সে ক্ষেত্রে মামলা পরিচালনার ব্যয়ও অভিযুক্তের কাছ থেকে আদালত আদায় করে দিতে পারে। তবে লিখিত চুক্তি হওয়াটাই ভালো। কারণ মৌখিক চুক্তি প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ভূমিসংক্রান্ত চুক্তি করলে অবশ্যই নিবন্ধন করতে হবে। তা না হলে আইনে আপনি সহযোগিতা পাবেন না। সর্বোপরি চুক্তি করার সময় চুক্তির খসড়াটা ভালো করে দেখ নিন, খুঁটিনাটি দিক যাচাই করে নিলে প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আর যদি কেউ আপনার বিশ্বাস ভঙ্গ করে থাকে, আমানতের খেয়ানত করে থাকে, অঙ্গীকার পালন না করে, বিশ্বাস ভেঙে চম্পট দেয় তাহলে আপনি সেই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। দন্ডবিধির ৪০৬ ধারায় প্রতিকার চাইতে হয়। দন্ডবিধির ৪০৬ ধারায় বলা আছে, অপরাধজনিত বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে দোষী হলে দায়ী ব্যক্তিকে তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে হবে। বিশ্বাসভঙ্গ একটি জামিন -অযোগ্য অপরাধ। যদি কোনো অফিসের কর্মচারী বিশ্বাসভঙ্গ করেন তাহলে দন্ডবিধির ৪০৮ ধারা অনুযায়ী সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। আর ৪০৯ ধারায় সরকারি কর্মচারী কিংবা ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা এজেন্টের এ অপরাধের সাজা যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডসহ অর্থদন্ড।

থানায় এজাহার দায়ের করে মামলা করা যায় অথবা আদালতে সরাসরি মামলা করা যায়। এ মামলা করতে হয় সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। আদালত বাদীর জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে মামলার গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে সরাসরি মামলাটি আমলে নিতে পারে অথবা কোনো প্রাথমিক তদন্তের জন্য ব্যক্তি বা সংস্থাকে আদেশ দিতে পারে। আবার সরাসরি এজাহার হিসেবে গ্রহণের জন্য থানাকেও নির্দেশ দিতে পারে। এ ধরনের মামলায় কোনো প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন না-ও হতে পারে। তবে অফিসের কর্মচারী বা সরকারি অফিসের কর্মচারী, ব্যবসায়ী বা এজেন্টের বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ দায়ের করবে দুর্নীতি দমন কমিশন।

 

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

[email protected]

সর্বশেষ খবর