বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

রক্তের দামে কেনা আমাদের বিজয়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রক্তের দামে কেনা আমাদের বিজয়

আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। দীর্ঘ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসন-শোষণকে কবর দিয়ে এ দেশের দামাল সন্তানরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ মাসেই ছিনিয়ে এনেছিলেন বাঙালি জাতির আকাক্সিক্ষত স্বপ্ন, প্রাণের স্বাধীনতা। পাকিস্তানিদের জুলুম-নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছিলেন আমাদের এ মাতৃভূমিকে। এ মাসেই জন্ম হয়েছিল আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল বিজয়ের রক্তিম সূর্য। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিন। মহান বিজয়ের দিন।

প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জীবনে ফিরে আসে সংগ্রামী সেসব ইতিহাস নিয়ে, যে ইতিহাসের প্রতিটি অক্ষর লেখা এ দেশের লাখো মানুষের রক্তবিন্দু দিয়ে। ১৯০ বছর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি আমাদের শোষণ করেছে। এরপর ব্রিটিশ চলে গেল। দেশ ভাগ হলো। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হিন্দুরা ভারত আর ইসলামের সুমহান আদর্শের ওপর ভিত্তি করে মুসলমানরা গঠন করল পাকিস্তান। পাকিস্তান হলো দুটি ভূখন্ডের সমন্বয়ের নাম। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। দুই দেশের মানুষই মুসলমান। তারা এক আল্লাহকে সিজদা করে, একই দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ পড়ে। তারা এমন নবীর উম্মত যাঁর স্পষ্ট নির্দেশ- ‘মুসলমান ভাই ভাই’। কাজেই ভাষা, সংস্কৃতি ও ভূখন্ডের ফারাক ধর্মের মেলবন্ধনকে ছিন্ন করতে পারবে না এমনটাই ভাবনা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক তার উল্টো।

পাকিস্তানের নেতারা ভুলে গেলেন তাদের প্রদত্ত ওয়াদার কথা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে পদে পদে বঞ্চিত করেছিল তারা। ঔদ্ধত্য তাদের এতটাই অন্ধ করে দিয়েছিল যে এ দেশের শত বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত সহজ-সরল মানুষের বুকে গুলি চালাতেও তারা দ্বিধাবোধ করেনি। ভাষার জন্য, ন্যায্য অধিকারের জন্য বারবার বাঙালির রক্ত ঝরতে থাকে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? অন্যায় যে করে আর যে সহে দুজনই সমান অপরাধী। তাই বাংলার দামাল ছেলেরা গর্জে ওঠে। শুরু হয় মাতৃভাষা রক্ষার লড়াই। আর এ লড়াইয়ের স্ফুলিঙ্গ থেকেই জ্বলে উঠল মুক্তিযুদ্ধের মশাল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এ দেশের অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে। মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। সেই অগণিত মানুষের অগণন ত্যাগ-তিতিক্ষার ফসলই হলো এ বিজয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির প্রাণে প্রাণে বেজে উঠেছিল এ বিজয়ের সুর। ছড়িয়ে পড়েছিল সৃষ্টিসুখের উল্লাস। নবীজি (সা.) যেদিন মক্কা বিজয় করলেন সেদিন তিনি এত আনন্দিত হয়েছিলেন যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। তিনি সেদিন বিজয় উদযাপন করেছিলেন আট রাকাত নফল নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে। (জাদুল মা’আদ, ইবনুল কাইয়িম জাওজি)। এই যে তিনি আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন এটা তো বিজয়েরই আনন্দে। মহান রবের শুকরিয়ায়। আমাদের এ আনন্দ ইমানেরই বহিঃপ্রকাশ। কেন না দেশপ্রেম তো ইমানের অংশ। নবী বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা দেওয়া এক মাস পর্যন্ত সিয়াম পালন ও এক মাস ধরে রাতে সালাত আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। যদি এ অবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে তাহলে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে। তার রিজিক অব্যাহত থাকবে। কবর-হাশরের ফিতনা থেকে সে নিরাপদ থাকবে।’

                লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।

সর্বশেষ খবর