রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

মহামারিতে মারা যান সাহাবি আবু ওবায়দা

এম এ মান্নান

মহামারিতে মারা যান সাহাবি আবু ওবায়দা

সারা দুনিয়া করোনাভাইরাস নামের মহামারিতে ভুগছে। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের আমলে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী খেলাফতের একটি বিরাট অংশে প্লেগ নামের ভয়াবহ মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। তাতে মারা যায় বিপুল-সংখ্যক মানুষ। যার মধ্যে শামের গভর্নর ও বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু ওবায়দা বিন জাররাহ (রা.) ছিলেন। সে সময় শামে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তাঁর প্রদেশবাসী এবং মুসলিম সেনাদের ছেড়ে নিরাপদ এলাকায় যেতে রাজি হননি।

ফিলিস্তিনের আল কুদস ও রামলার মধ্যভাগে অবস্থিত একটি এলাকা ইমওয়াস। সেখানে প্লেগ প্রথম প্রকাশ পায়। এরপর তা প্রাচীন শামদেশ অর্থাৎ বর্তমানের সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাসে তা ‘তাউন ইমওয়াস’ নামে পরিচিত। ১৭ হিজরি সনে হজরত ওমর (রা.) শাম সফরে যান। তিনি শামে পৌঁছার পর শুনতে পান সেখানে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে। তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করছে। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত, ‘ওমর বিন খাত্তাব (রা.) শামের উদ্দেশে বের হন। শামে অবস্থিত তাবুক গ্রামের সারগ নামক এলাকার কাছে এলে আবু ওবায়দা ও অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা হয়। হজরত ওমর (রা.)-কে তাঁরা জানান শামে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁদের কথা শুনে ওমর (রা.) আমাকে বলেন, ইসলামের প্রথম পর্যায়ের মুহাজিরদের ডাক দাও। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয়। কেউ বলেন আপনি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন, তা না করে ফিরে যাওয়া আমরা সমীচীন মনে করছি না। অনেকে বলেন, আপনার সঙ্গে অনেক মানুষ ও রসুল (সা.)-এর মহান সাহাবিরা আছেন। এ অবস্থায় তাঁদের নিয়ে আপনি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় যাবেন না। সবার কথা শুনে ওমর (রা.) বলেন, “তোমরা চলে যাও।” হজরত ওমর (রা.) আমাকে বলেন আনসারদের ডেকে আন। তাঁদের ডেকে পরামর্শ করেন। তাঁরাও মুহাজিরদের মতো মতবিরোধ করল। তিনি বলেন, তোমরা চলে যাও। এরপর আমাকে বলেন, কুরাইশ বংশের প্রবীণ মুহাজির সাহাবিদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনি। তাঁদের মধ্যে কেউ মতবিরোধ করলেন না। সবাই বললেন, “আমরা মনে করছি আপনি সব মানুষকে নিয়ে ফিরে যান। মানুষকে এ মহামারিতে নেবেন না।” এরপর ওমর (রা.) সবাইকে সামনে নিয়ে ঘোষণা দিলেন, “আমি চলে যাব। তোমরাও চলে যাও।” এ কথা শুনে আবু ওবায়দা (রা.) বললেন, “আপনি আল্লাহর তাকদির থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন?” ওমর (রা.) বলেন, “আঃ, হে আবু ওবায়দা, এমন কথা তুমি ছাড়া অন্য কেউ বলত!” মূলত ওমর (রা.) তাঁর মতভিন্নতাকে অপছন্দ করেন। ওমর (রা.) আবু ওবায়দার প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদির থেকে অন্য তাকদিরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছি। যেমন মনে কর তোমার অনেক উট আছে। তা নিয়ে তুমি এক উপত্যকায় এসেছ। উপত্যকার দুটি প্রান্ত আছে। এক প্রান্ত উর্বর। আরেক প্রান্ত শুষ্ক। তুমি উর্বর প্রান্তে উট চরালে কি আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না? এবং শুষ্ক প্রান্তে চরালেও কি আল্লাহর তাকদিরের ওপর নির্ভর করবে না?” কিছুক্ষণ পর আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) এলেন। কোনো এক প্রয়োজনে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, আমি রসুল (সা.)-এর কাছে শুনেছি, “তোমরা কোনো এলাকায় প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা শুনলে সেখানে প্রবেশ করবে না। তবে সেখানে থাকাবস্থায় প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়লে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।” এ কথা শুনে ওমর (রা.) আলহামদুলিল্লাহ বললেন। এরপর সবাই ফিরে গেলেন।’ বুখারি।

মদিনায় ফিরে হজরত ওমর (রা.) মহামারি চরম আকার ধারণের খবর অবগত হন। তিনি চাইলেন শামের গভর্নর ও বীর সেনাপতি আবু ওবায়দা (রা.)-কে ফিরিয়ে আনতে। তাই ওমর (রা.) একটি চিঠি লিখলেন, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ সম্পর্কে সরাসরি তোমাকে বলতে চাই। তাই তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলছি, আমার পত্র পড়ে আমার উদ্দেশে বের হওয়ার আগে পত্রটি তোমার হাতছাড়া করবে না। রাতে পত্র পৌঁছলে সকাল হওয়ার আগেই যাত্রা করবে। আর দিনের বেলায় পৌঁছলে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যাত্রা করবে।’ আবু ওবায়দা (রা.) পত্র পড়ে খলিফার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমিরুল মুমিনিনকে ক্ষমা করুন।’ এরপর ওমর (রা.)-এর উদ্দেশে একটি পত্র লিখলেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আমি আপনার প্রয়োজনের বিষয় বুঝেছি। আমি এখন মুসলিম সেনাবাহিনীতে অবস্থান করছি। তাদের ছেড়ে যেতে চাই না। আল্লাহতায়ালা আমিসহ সবার ব্যাপারে ফয়সালা করবেন। অতএব হে আমিরুল মুমিনিন! আপনার সিদ্ধান্ত থেকে আমাকে মুক্ত করুন। আমার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাকে ছেড়ে দিন।’

হজরত আবু উবায়দা (রা.)-এর পত্র পড়ে খলিফা হজরত ওমর (রা.) কাঁদতে থাকেন। আশপাশের মুসলিমরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আবু ওবায়দা কি শহীদ হয়েছেন? ওমর (রা.) বলেন, ‘না, তিনি এখনো শহীদ হননি। কিন্তু...।’ অর্থাৎ শিগগির তিনি শহীদ হবেন।’ এর পরই আবু ওবায়দা (রা.) প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। প্লেগে হজরত আবু ওবায়দার (রা.) মৃত্যু ছিল ইসলামী উম্মাহর জন্য এক বড় আঘাত। তিনি ছিলেন সাহসী ও প্রজ্ঞাবান একজন সাহাবি।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর