তাবলিগ জামাতের অন্যতম একটি কর্মসূচি হলো ইজতেমা। তাবলিগ শব্দটি আরবি। এর অর্থ প্রচার করা, পৌঁছে দেওয়া। আর তাবলিগ জামাত মানে প্রচার দল, প্রচারসংঘ। বস্তুত মহান আল্লাহতায়ালা বিশ্বমানবতার কল্যাণে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে যে ধর্ম প্রবর্তন করেছেন এর প্রচার-প্রসারের নাম হচ্ছে তাবলিগ। আল কোরআনে মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘হে রসুল! আপনার প্রতিপালকের কাছ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা আপনি তাবলিগ করুন, পৌঁছে দিন। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর বার্তা পৌঁছালেন না।’ (সুরা আল মায়িদাহ-৬৭)। অপর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।’ (সুরা আলে ইমরান-১১০)। কোরআন সুন্নাহর আলোকে তাবলিগ বা ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার করা একটি ফরজ কাজ। যুগ-যুগান্তরে মুসলিম উম্মাহ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এই মহান দায়িত্ব পালন করে আসছে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশে এক বিশেষ পদ্ধতিতে দাওয়াতি কার্যক্রম ও ইসলামের প্রচার-প্রসার প্রবর্তন করেন। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এই পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া জাগায়। সর্বস্তরে তা সমাদৃত হয়। পর্যায়ক্রমে এ পদ্ধতিতে ইসলামের প্রচার-প্রসার ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ববাসীর কাছে এই মিশন ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মোবারক জামাত প্রসঙ্গে এক প্রতিক্রিয়ায় প্রখ্যাত গবেষক সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) লিখেন, যেখানে মসজিদ দেখা যেত না, তাবলিগ জামাতের মেহনতের ফলে সেখানে মসজিদ তৈরি হয়, মুসল্লির আগমন ঘটে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। সমাজের চিহ্নিত অপরাধীরা খোদাভীরু হতে থাকে। এই জামাত বিশ্বে এমন এক বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করে, যার উদাহরণ ইসলামের স্বর্ণযুগের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাবলিগ জামাতের বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রমের বিশেষ একটি কাজ হলো, ইজতেমা। এর উদ্দেশ্য হলো, বেশি পরিমাণে লোক একত্র করে তাদের তাবলিগের কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং বেশি বেশি জামাত তাবলিগের কাজের জন্য প্রস্তুত করা। শুধু বয়ান শোনানো তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা বয়ানের মাধ্যমে ধর্মীয় কাজের বাস্তব প্রশিক্ষণ হয় না। বরং এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। মেহনতের প্রয়োজন। আর এই সময় লাগানোর জন্য মানুষকে প্রস্তুত করার উন্মুক্ত সুযোগ হলো ইজতেমা। ইজতেমা শুধু বাংলাদেশেই হয় না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ইজতেমা হয়ে থাকে। কোথাও পুরো দেশ নিয়ে হয়, কোথাও কয়েকটি দেশ মিলে হয়, কখনো একটা দেশের প্রদেশ বা অঞ্চলেরও ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন জেলায় ইজতেমা হয়ে থাকে। পঞ্চাশ দশকে বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে কাকরাইল মসজিদকেন্দ্রিক তা চলতে থাকে। তৎকালীন বাংলাদেশের তাবলিগ জামাতের আমির ছিলেন মাওলানা আবদুল আজীজ (রহ.)। ওই বছর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর পর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে দ্বিতীয়বারের মতো ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তার ১০ বছর পর ১৯৫৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশে এবং বিশ্বে বিভিন্ন দেশের তাবলিগ সাথিদের সমন্বয়ে টঙ্গীর ১৬০ একর জায়গায় বিশাল মাঠে এই ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। যা পুরো বিশ্বব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এই ইজতেমায় বিশ্বের শতাধিক দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা