গায়ের রং শ্বেতাঙ্গদের মতো উজ্জ্বল না হলেও মার্কিন রাজনীতির আকাশে এখন ঠিকই উজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বলছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তিনি নিজেও দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পেতে স্বামী হ্যারিসকে সঙ্গে নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য।
২২ জুলাই ২০২৪, সোমবার ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় বাংলাদেশের কোটি কোটি চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে নাশকতা এবং পরবর্তীতে আদালতের রায় ও সরকারি প্রজ্ঞাপনের প্রত্যাশা ইত্যাদি নানা বিষয়ে জানতে উৎসুক মানুষ ছিল টেলিভিশনমুখী। একই সময়ে বিশ্ববাসীও আগ্রহ নিয়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জানতে চাচ্ছিল কী ঘটতে যাচ্ছে আমেরিকায়। কারণ তিনটি ঘটনা এই দিনটিকে নাটকীয়তার শীর্ষে তুলে দিয়েছিল। এদিন আগের অবস্থান থেকে সরে ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হবেন না- হঠাৎ করেই এমন ঘোষণা দেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি বলে প্রচার করেন।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস বিভাগের পরিচালক মিস কিমবার্লি চিটলিকে এদিন হাজির হতে হয় আমেরিকার আইনসভা তথা কংগ্রেসের ‘হাউস ওভার সাইট কমিটি’র সামনে। হাত তুলে ‘সব সত্য এবং কেবল সত্য’ বলার শপথ নিয়ে তাকে বলতে হয়, সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান দলের হয়ে আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট পদে আবারও নির্বাচন করতে যাওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন গুলিবিদ্ধ হলেন। তাঁকে হত্যাচেষ্টা ঠেকাতে সিক্রেট সার্ভিস কেন ব্যর্থ হলো, তার কৈফিয়ত তিনি দিতে বাধ্য হন, যা সম্প্রচার করেছে কয়েক ডজন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। আর সরাসরি তা প্রত্যক্ষ করেছেন আমেরিকাসহ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। তৃতীয়ত, এদিন আমেরিকার পথে রাষ্ট্রীয় সফরে যাত্রা করেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে লক্ষ্যণীয়, তিনি যেদিন যাত্রা করলেন, সেদিনও গাজার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত খান ইউনিসে বোমা হামলায় মারা যায় ৭০ জন ফিলিস্তিনি নাগরিক। যাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। মানবিক সাহায্য পাওয়ার জন্য নির্ধারিত এই স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল কয়েক শ ফিলিস্তিনি। তবে এখান থেকে রকেট ছোড়ার অভিযোগ এনে হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এমন ঘটনাকে পেছনে ফেলেই আমেরিকার পথ ধরেন নেতানিয়াহু, যিনি আমেরিকার বিশেষত, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অনুরোধ সত্ত্বেও অস্ত্রবিরতি করতে অস্বীকার করে আসছেন। তবে এবার সফরের সময় তিনি আমেরিকার কংগ্রেসে বক্তব্য রাখবেন এবং তার অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। পক্ষান্তরে কংগ্রেস সদস্যবৃন্দ, যারা জো বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক ইসরায়েলকে সব ধরনের সহায়তা করার অনুমোদন দিয়েছেন এবং নিজ দেশেও জনগণের একটি অংশ বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরাগভাজন হয়েছেন, তারা নেতানিয়াহুকে সামনে পেয়ে কী বলেন আর নেতানিয়াহুই বা কী উত্তর দেন, তা দেখার অপেক্ষায় ইসরায়েলের পক্ষ ও বিপক্ষ- উভয় দিককার মানুষ।
আমেরিকার রাজনীতিতে কমলা হ্যারিস পরিচিত মুখ হলেও হঠাৎ করে ধ্রুবতারার মতো তার এমন বিচ্ছুরণ ঘটবে- তা কেউই প্রত্যাশা করেনি। গত ২৭ জুন আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে প্রথা মাফিক টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থিতা। এই বিতর্কে রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ ড্যাশিং ইমেজ এবং বাকপটুতা নিয়ে আবারও হাজির হন জাতি তথা বিশ্ববাসীর সামনে। পক্ষান্তরে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ছিলেন ধীরস্থির ও কিছুটা ম্রিয়মাণ। ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক কথার যুতসই জবাব বাইডেন দিতে পারেননি বলেই ধরে নিয়েছিল বেশির ভাগ দর্শক, এমনকি খোদ ডেমোক্র্যাটরা। সেদিন থেকেই জোরেশোরে আওয়াজ ও দাবি উঠেছে জো বাইডেন যেন সরে দাঁড়ান। কোনো কোনো ডেমোক্র্যাট সমর্থক, কর্মী ও নেতা জো বাইডেন নির্বাচন করলে দলীয় তহবিলে অনুদান দেবেন না বলেও ঘোষণা দেন।
এরই মধ্যে গত সপ্তাহে খবর প্রকাশিত হয় যে, করোনা আক্রান্ত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনি প্রচারণার এই মৌসুমে বিশেষত ১৫ জুলাই ট্রাম্প যখন রিপাবলিকানদের সম্মেলনে দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা গ্রহণ করেন এবং পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে নিজস্ব টিম নিজের পুত্রদের নিয়ে প্রচারণার ঝড় শুরু করেন, তখন ডেমোক্র্যাট শিবিরে সুর ওঠে- জো বাইডেন কি ‘আইসোলেশনে’ যাচ্ছেন? কয়দিন বিশ্রামে থাকবেন তিনি? এমতাবস্থায় ২২ জুলাই (সোমবার) জো বাইডেন নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত জানান। আমেরিকার ইতিহাসে নির্বাচনের এমন কম-বেশি ১০০ দিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘটনা ঘটে না। ১৯৬৮ সালে একবারই এমনটা ঘটেছিল, তাও আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার জড়িত হওয়া বিশেষত ভিয়েতনামের মাটিতে আমেরিকান সৈন্যদের বিতর্কিত কার্যকলাপকে সামনে রেখে। এরপর প্রায় ৫৬ বছর এমনটি ঘটেনি তা ঘটল ২২ জুলাই ২০২৪ তারিখে।
ডেমোক্র্যাটদের প্রার্থী নির্বাচন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আসছে এক মাসের মধ্যেই দলীয় সম্মেলনে তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। তবে কমলা হ্যারিসকে নিয়ে যারা স্বপ্ন বুনছেন, তাদের ভাবনায় রয়েছে বেশকিছু বাস্তবতা। তারা ভাবছেন নারীর ক্ষমতায়নের যুগে কমলা হ্যারিস নারী হিসেবে ভোটারদের ভোট পাবেন। তিনি শ্বেতাঙ্গ নন বলে বিপুলসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ও ধর্মীয়ভাবে কোণঠাসা ভোটাররা কমলাকেই বেছে নেবেন। অন্যদিকে আমেরিকান ভোটারদের একটা বিরাট অংশই কমলা হ্যারিসের মতো অন্য দেশ থেকে এসে আমেরিকার মাটিতে স্থায়ী হয়েছেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট বিশেষত অভিবাসনসংক্রান্ত বিষয়ে কমলা হ্যারিস সংবেদনশীল হবেন বলেই ধারণা একদল ভোটারের। আর ভারত উপমহাদেশ বিশেষত ভারতীয়দের কাছে কমলা যেন ঘরের মেয়ে। এমন লক্ষ্মীকে বরণ করে নিতে উন্মুখ হয়ে আছেন ভারতীয় উপমহাদেশে শেকড় আছে- এমন ভোটাররা।
তারই প্রতিফলন ঘটেছে ডেমোক্র্যাটদের নির্বাচনি তহবিল সংগ্রহের চিত্রে। কমলা হ্যারিস নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রায় ১০০০ কোটি টাকা নির্বাচনি তহবিলে জমা হয়, যা একটি রেকর্ড। আরও মজার বিষয় হলো, এ তহবিলের বড় অংশ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এসেছে, ব্যবসায়ী নয়।
যারা স্থিতিশীল আমেরিকার পক্ষে, তাদেরও পছন্দ কমলা হ্যারিস। কারণ তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পাশে থেকে গত প্রায় চার বছর আমেরিকার নীতি-নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলে প্রশাসনে তেমন রদবদল হবে না বলেই ধরা যায়। পক্ষান্তরে অন্য কেউ বিশেষত রিপাবলিকানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসেন, তবে ব্যক্তি, নীতি ও পদ্ধতিগত ব্যাপক রদবদল ঘটবে, যা অনেকেরই অপছন্দ কিংবা স্বার্থবিরোধী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জো বাইডেন প্রশাসন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বরাবর ইউক্রেনের পাশে ছিলেন এবং নানাভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা করেছেন। পক্ষান্তরে ডোনাল্ড ট্রম্প স্রেফ জানিয়ে দিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিষয়। এখানে আমেরিকার নাক গলানোর কিছু নেই। সব মিলিয়ে বলা যায়, বেশ জমে উঠেছে আমেরিকার রাজনীতি। কমলা হ্যারিসকে ‘হরিবল’ (বিরক্তিকর) ও ‘ইনকমপিটেন্ট’ (অযোগ্য) বলে মন্তব্য করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর মন জয় করা হাসিটি দিয়ে কমলা বলেছেন, ‘জয় হবে ডেমোক্র্যাটদের। জয় হবে গণতন্ত্রের।’ তবে শেষ হাসি কে হাসবেন, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আরও ১০০ দিন।
লেখাটা শেষ করার পর খবর ছড়ালো পদত্যাগ করেছেন আমেরিকার ‘সিক্রেট সার্ভিসের পরিচালক কিমবার্লি চিটলি। ২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সিক্রেট সার্ভিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটির দায়িত্ব তুলে দেন দীর্ঘদিন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা দায়িত্বে থাকা চিটলির হাতে। আমেরিকার জাতীয় নেতাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে সে দেশের সিক্রেট সার্ভিস বিভাগ। এখানে সেই নেতা কোন দলের, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা সিক্রেট সার্ভিস জনগণের নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, এটাই বিবেচ্য বিষয়, অন্য কিছু নয়। তবে ১৩ জুলাই নির্বাচনি জনসভায় ডোনাল্ড ট্রাম্প কানে গুলিবিদ্ধ হলে প্রমাণ হয় সিক্রেট সার্ভিস তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার কথা কংগ্রেসে জবাবদিহিতার সময় স্বীকারও করেছেন। পরিচালক হিসেবে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সব দায় নিজের কাঁধে তুলেও নিয়েছেন। তবে ক্ষমতা বা পদ থেকে সরে যাওয়ার বা পদত্যাগের পক্ষে ছিলেন না কিমবার্লি চিটলি। কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর দিতে সম্মত না হওয়ায় এবং বেশকিছু প্রশ্নের সরাসরি উত্তর কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ায় তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন কংগ্রেসের ‘হাউস ওভার সাইট’ কমিটির সদস্যরা।
শেষ পর্যন্ত তিনি পদত্যাগ করলেন। সেই সঙ্গে যারা কংগ্রেসে এই গোয়েন্দা প্রধানের জবাবদিহিতা পর্ব সরাসরি বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছেন, তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে উত্তর দিতে হয়, কীভাবে কাউকে বিব্রত না করে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে হয়, শিখিয়ে গেছেন এই ঝানু গোয়েন্দা প্রধান। আমরা যখন বলি ব্যক্তির দায় বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান নেবে না, তখন নিজ বিভাগের পক্ষে চিটলি বলেন, ‘আই টেইক ফুল রেসপনসিবিলিটি’ (আমি সম্পূর্ণ দায় নিচ্ছি)। এভাবেই একজন চিটলি ইতিহাস হয়ে যান, আবার কোনো কোনো বাহিনী প্রধান ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ঠাঁই পান। ব্যক্তিস্বার্থে দায়িত্বহীন আচরণের জন্য।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট