বড্ড আশায় বুক বেঁধে আনন্দ অশ্রুতে সিক্ত হয়ে এ লেখা লিখছি। সবুজ ও তাজা তরুণরা দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির আত্মধ্বংসে সম্মোহিত আধমরাদের ঘা মেরে জাগানোর যে অয়োময় প্রত্যয় প্রদর্শন করেছে তাতে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এর ৫৩ বছর পর ‘মুক্তির সংগ্রাম’-এ বিজয় অর্জিত হয়েছে। তারা আমাদের আত্মবিশ্বাসের উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। এই বিজয় রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্রান্তিকাল উত্তরণে নতুন উদ্যম ও সাহস জোগাবে। এ বিজয়ে স্বার্থবাদী রাজনীতি নাস্তানাবুদ হয়েছে, এটি জাতিকে বিভক্তকরণের দীর্ঘদিনের একদেশদর্শিতা, ব্যক্তিবন্দনা, গোঁয়ার্তুমি, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, আত্মশ্লাঘা, অহংবোধ ও অপশক্তির অপব্যবহার এবং স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনৈতিক উৎকোচ প্রথার অতি অপব্যবহারের প্রতি প্রচন্ড চপেটাঘাত। এ বিজয় রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে স্বনির্ভর ও স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে আমাদের আত্মশক্তির অর্থবহ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে। একই সঙ্গে এই জাগরণ দূরের ও কাছের ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইদের কাছে আমাদের একক শক্তিমত্তার একটি শক্ত বার্তা পৌঁছবে। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধানে সক্ষম এটা প্রতিফলিত হবে। এই জাগরণ আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি উন্নয়নে শক্তি ও সাহস জোগাবে। অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা অর্জন ব্যতিরেকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ় করা সম্ভব নয় - এই উপলব্ধির আজ বেশি প্রয়োজন। পারস্পরিক দোষারোপের দ্বার আমরাই আমাদের শত্রু হয়ে নয়, বিভেদ বিভাজন বিভ্রান্তি বিচ্যুতির পরিবর্তে অন্তর্ভুুক্তির চিন্তা ও চেতনায় জাগ্রত হওয়ার আহ্বান এবারের গণঅভ্যুত্থানের মর্মবাণী।
আপামর জনসাধারণ (সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভেই উল্লেখ মতো আমরা বাংলাদেশের জনগণ) যেখানে যে উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সেটিকে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই দলীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত করণের দৃষ্টিভঙ্গিতে জলাঞ্জলি দেওয়ার আত্মঘাতী প্রয়াস প্রচেষ্টার কারণে অর্থনীতিকেই দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর বিশেষ করে ১৯৭৪ এ সীমাহীন অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা পরবর্তী প্রজন্ম জানে না। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে সীমাহীন বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিবরেই ১৯৪৭ এ ভারত বিভাগ এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ৫৩ বছর বয়সি সেই স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে’ অর্ধ সহস্রাধিক (এখন পর্যন্ত অগণিত) প্রাণ দিতে হয়েছে। সম্ভাবনাময় অর্থনীতিকে শোষণের হাতিয়ার বানিয়ে, সুশাসন ও জবাবদিহি রহিত উন্নয়ন সংগীতের মূর্ছনায় দেশ, সমাজ ও রাজনীতিকে দুর্নীতির দাবানলে জ্বালানো ও পোড়ানো হয়েছে। মানবাধিকারের প্রশ্নে মূক ও বধির বানানো হয়েছে। নিজ সেনাপতি ম্যাকবেথের গ্রহে অতি নিরাপদ আতিথেয়তা গ্রহণকালে রাজা ডানকানকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করা হলে খুনি ম্যাকবেথ দম্পতি আর কখনো ঘুমাতে পারেনি, এ কথা বলা কি অযৌক্তিক ও অসংগত হবে যে গণতন্ত্রের জন্য আজীবন লড়াকু নেতা নিজ হাতে গণতন্ত্রকে হত্যা করে থাকলে তার প্রজন্ম জাতি কি কখনো গণতন্ত্র ফিরে পাবে? কাফফারা আর কত দিতে হবে? বাকি রাত পোহাবার প্রেরণা নিয়ে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। গোটা জাতিকে এবারের অগণিত শহীদানদের রক্তের ঋণ শোধ করার কোনো বিকল্প নেই। এবারের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা যথার্থই উচ্চারণ করেছেন ‘আর যেন কোনো স্বৈরাচারের জন্ম না হয় এই বাংলায়’ সে লক্ষ্যে তারা রাষ্ট্রকে উপযুক্তভাবে মেরামতে মন দিয়েছেন।
রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের শোভন সংস্কার আজ অন্যতম দাবি। আগেও কম বেশি ছিল কিন্তু বিগত দেড় দশকে হয় সরকার রাষ্ট্রকে অধিগ্রহণ করেছে নয় রাষ্ট্র সরকারের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ফলে রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হয়েছে, রাজনৈতিক উৎকোচ দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনাকে সরকার নিজের কবজায় নিয়ে নিয়েছে। দান প্রতিদানে বড় বড় দানব তৈরি হয়েছে, সিন্ডিকেট সরকারকে এবং সরকার সিন্ডিকেটকে পারস্পরিক সুরক্ষা দান করে। এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখার বিপদ জানা সত্ত্বেও সুযোগসন্ধানী চাটুকররাই, দলের লোকেরাই স্বৈরাচারকে খতম তারাবির আগেও অভয় দিয়ে ‘আমরা আপনার সঙ্গে আছি’ বলে নেক্সট ফ্লাইটে কাট মারেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বঙ্গবন্ধুর একটি স্বগোতুক্তি আছে ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদের সঙ্গে কোনো দিন একসঙ্গে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশ সেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’
রাজনৈতিক অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে মোটা দাগে দৃশ্যমান সমস্যাগুলো এ রকম অব্যাহত মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক রিজার্ভের পতন, রাজস্ব সংগ্রহের স্বল্পতা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের স্থবিরতা, পুঁজি পাচার, ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম-অপচয়, জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতি এবং বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ খাতের ঋণের সুদ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান দায়। এ বছরের বাজেটে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয়কে ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে বিনাপ্রশ্নে বৈধ করার প্রস্তাবিত সুবিধা অন্যায্য ও অনৈতিক। অর্থনীতিতে অনৈতিকতার বিষয় এত উদগ্র ও বেসামাল যে একটা নৈতিকতাহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে দেশ। সর্বভুক অর্থনীতিতে ব্যয়ের বহর বাড়িয়ে পাছে টাকা লাগলে দেবে গৌরী সেন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। গৌরী সেন তো নিজের পকেটের টাকা দেবে না, হয় চাহিদা মাত্র বাহককে দেওয়ার দায়িত্ব পালনার্থে নিজ স্বাক্ষরে (ক্যাশলেসের স্লোগান দিয়েও) নগদ নোট ছাপিয়ে (এত সুন্দর প্রিন্টিং প্রেস আছে না!) নয়তো কঠিন শর্তেও ধার কর্জ করে (ভবিষ্যৎ অর্থনীতির সুদাসলের কিস্তির সুগার বা ডায়াবেটিস বাড়িয়ে হাইপো হলে ক্ষতি কী?) বর্তমানে মুচলেকা দানকারী খাতকের তাতে ব্যক্তিগত কিছু হবে না, ঋণভারে জর্জরিত হবে, মাজা ভেঙে যাবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমজনতার ঢল নামার এটিও একটি নেপথ্য কারণ।
জিডিপি, রিজার্ভ, রপ্তানি ও রেভিনিউ আয়ের হিসাবায়ন ও প্রক্ষেপণ প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে যে, তাতে অর্থনীতি অনেকটা গরু মোটাতাজাকরণের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেখা গেছে জিডিপি, রিজার্ভ, রেভিনিউয়ের আকার বড় দেখিয়ে বিদেশ থেকে বড় বড় ঋণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বড় কাজের জন্য ঋণ নিতে সভারেন গ্যারিন্টিও দেওয়া হয়েছে, প্রচারের প্রগলভতায় উন্নয়ন বয়ানে রাজনৈতিক সুনাম সুখ্যাতি - স্বার্থ উদ্ধারের গ্রোথ দৃশ্যমান হয়েছে। সুশাসনবঞ্চিত প্রচার-সর্বস্ব উন্নয়নই ক্ষমতায় থাকার অবলম্বন সাব্যস্ত হয়। ব্যাংকিং ও বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত সিন্ডিকেটের হাতে বন্দিত্ববরণ করায় অর্থ পাচার, উদ্যোক্তা পাচার সবই সহজ হয়েছে। দেশে বিনিয়োগ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে, দক্ষ জনবল গড়ে না তুলে বিদেশে বিনিয়োগের বাহাদুরি বেড়ে গেল। দেশের মানুষ কাজ পায় না সেখানে সিঙ্গাপুরে ৪০তম ধনী কোম্পানি হয়ে ওঠে বাংলাদেশি সিন্ডিকেট। ভাশুরের মতো নাম নেওয়া যাবে না এমন সিন্ডিকেটের দুর্নীর্তির তদন্ত করতে মহামান্য আদালতের সায় মেলে না। প্রকৃত আকারের চেয়ে জিডিপি, বাজেট ব্যয়, রিজার্ভ বড় দেখানোর মনোভঙ্গি প্রকাশ পাওয়ায় আয়ের সমবণ্টন হয়নি, উল্টো বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। কিছু মানুষের কাছে প্রচুর অর্থ আর অধিকাংশ মানুষের কাছে অর্থ নেই, এমন অবস্থা তৈরি হয়েই তরুণদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে এবং তা গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার শানে নজুল এখানেই। যাদের জন্য জিডিপিকে মোটাতাজা করা হয়েছে, তারা করের আওতার বাইরে থেকে গেছে। কর প্রদানযোগ্য অধিকাংশ ব্যক্তির কাছ থেকে ট্যাক্স নেওয়া হয় না। দেশের বড় মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে যে সব জিনিসপত্র, পরামর্শক, দেশি-বিদেশি ঠিকাদার তাদের শুরুতেই কর মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। মওকুফকৃত করের টাকাসহ প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় কত সেটা ঠিক না রাখলে সুশাসন সুদূরপরাহত থেকে যায়। প্রকল্পের খরচ থেকে সেই কর মাফ দেওয়ায় সরকার একদিকে কর হিসাবভুক্ত করেনি, অন্যদিকে দেখানো হলো প্রকল্পে বেশি খরচ হয়নি। প্রকৃত হিসাবটি অন্ধকারে রাখতেই সরকার আগেভাগেই কর মাফ করে দেয়। যেমন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ইমুউনিটি দিয়ে দুর্নীতি বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
লেখক : সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান