চাটুকারদের ফাঁদে পড়েছিল দেশ। যখন যিনি ক্ষমতায় এসেছেন পরিবেষ্টিত হয়েছেন চাটুকারদের দ্বারা। ওদের কথা লিখতে গেলেও মাথা ঝিমঝিম করত। কাজ করত ভয়। ভাষা ও ভাবনায় যেন আড়ষ্টতা জড়িয়ে থাকত। কী বলব, কী লিখলে কোথায় যায়, কীভাবে কার কাছে উপস্থাপন করা হয় বলা বড় মুশকিল। এর চেয়ে ঢের ভালো কিছু বললাম না, কিছু করলাম না, কিছু দেখলাম না। এতে আর কিছু না হোক, অন্তত ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয় না। একবার এক অতি দায়িত্বশীল সচিব বন্ধু বলেছিলেন, ‘শোন, এখানে দোষগুণ, ভালোমন্দ বলে কিছু নেই। কর্তার সামনে সময়মতো কোমল মসৃণ শব্দে উপস্থাপনাই সব। কাজেই তোমার ভাড়া করা দরকার একজন চৌকশ মেধাবী উপস্থাপক। যিনি প্রভুর খোশমেজাজকালে মেসেজটা পৌঁছাতে পারেন। অন্য কিছু ততটা তাৎপর্যপূর্ণ নয়।’
২. গত কয়েক বছর ধরে একটা বিষয় নিবিড় অভিনিবেশ নিয়ে লক্ষ্য করে এসেছি। তা হলো সারা দেশে একশ্রেণির চাটুকার, চামচা, ধান্দাবাজ ও মোসাহেবদের জয়জয়কার। প্রায় সব পেশায় এদের সরব উপস্থিতি, এদের তৈলাক্ত কথামালা এবং অতি উৎসাহী স্তাবকতা যে কোনো সচেতন মানুষের চোখে পড়ার মতো। দর্শকের সারিতে বসা মানুষগুলো হাসুক, কাঁদুক এতে এদের কিছু যায় আসে না। এটা সমাজের সর্বস্তরে একদম বিনা বাধায় বিস্তার লাভ করে চলেছে। এরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে থাকছে। এরা কেন্দ্র প্রান্তসহ সর্বত্রগামী। এদের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারছে না সৎ, নিবেদিতপ্রাণ, সাহসী, দেশপ্রেমিক ও বিবেকবান মানুষগুলো। চাটুকারদের সর্বগ্রাসী কলাকৌশল আর দুর্নীতির নতুন টাকার দরদি বিনিয়োগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না অন্যরা। বরং ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে পড়তে একসময়ে এসে সমাজের ভালো মানুষগুলো হাল ছেড়ে দিয়ে বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে তাঁরা তাঁদের অতীতের গৌরবময় সমাজহিতৈষী কর্মযজ্ঞের জন্য অনুশোচনা করেন। এমনকি তাঁরা পরিবার এবং সমাজ থেকেও পরিহাস আর তাচ্ছিল্যের পাত্রে পরিণত হয়। তখনই তাঁদের জীবন হয়ে উঠে যন্ত্রণাদায়ক ও দুর্বিষহ। চাটুকার দুর্বৃত্তরা তখন শেষ সুযোগ নিয়ে বলে, ওনি তো বহুদিন থেকে কোনো কাজকর্মের ভিতরে নেই। তাঁর অনেক বয়স হয়ে গেছে, শুনেছি তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। অ্যাকটিভ থাকতে পারছেন না। তাকে দিয়ে আমাদের এখনকার এসব কাজ আর হবে না। দুর্ভাগ্যজনক হলো, যাঁর কাছে এমন বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে তাঁর বয়স কিন্তু নিবেদিতপ্রাণ সেই মানুষটির চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তাঁর হাতে ক্ষমতা আছে বলে তিনি সব পারেন। তিনি সুস্থ সবল। আবার ক্ষমতা না থাকলে তিনিই বৃদ্ধ, অথর্ব।
৩. দেশে চামচাদের বিস্তার মাশরুম পর্যায়ে পৌঁছায়। এ বদ্বীপের এমন উর্বর সোনার মাটিতে এরা কোনোক্রমে দুটো মলিন পত্র নিয়ে অঙ্কুরিত হতে পারলেই চোখের পলকে বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে এবং রাতারাতি এদের পল্লব ছায়ার বেষ্টনী দশদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে এদের রুখে দাঁড়ানোর আর কেউ নেই। এদের অব্যর্থ রণনীতির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে সাধারণ মানুষগুলো আজ অসহায় ও জিম্মি হয়ে আছে। প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই, ভাষাও নেই। কেননা চাটুকাররা ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে নতুন নতুন কলাকৌশল আরোপ করে দিব্যি টিকে থাকে। বাইরে থেকে নতুন করে কেউ নেতা বা বাড়ির মালিকের কাছে পৌঁছার কোনো সুযোগ তারা রাখে না। তাছাড়া তারা এত অর্বাচীন নয় যে, বাইরের বাস্তব চিত্র বা সঠিক মেসেজ নেতার কান অবধি পৌঁছতে দেবে। নেতাকে দুশ্চিন্তাহীন রাখাই ছিল তাদের প্রধান কর্তব্য। নেতা ভালো তো তারা ভালো। এক্ষেত্রে তারা ভাগ দিতে একেবারেই নারাজ। তাছাড়া যুগ-যুগান্তরব্যাপী তারাই যে নেতাকে আগলে রাখবে। তাঁর ভালোমন্দের দেখভাল করা, তাঁর হাসি-কান্নার সঙ্গে, তাঁর বচনের সঙ্গে, রুচির সঙ্গে আয়-রোজগারের সঙ্গে তারাই তো সম্পূর্ণরূপে পরিচিত। অন্য কেউ নয়। এখানে বাইরের কাউকে আনা নিরাপদ নয়। এদের ছাড়া নেতার যে এক দিনও চলে না। এরা থাকলেই নেতার চারপাশটা সদানন্দ, আমেজে ফকফকা, সুন্দর।
৪. আমাদের দেশের নেতারা প্রায় সব কানকথার রাজা। তাঁরা কানকথায় সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন, মুহূর্তে প্রাণিত হয়ে ওঠেন, এতে কখনো মুগ্ধ হন, কখনো ক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে প্রায় সব সময় প্রথম পার্টির জয় হয়। আগে গিয়ে নেতাকে বলতে পারলেই দারুণ সফলতা। এতে সত্য-মিথ্যার বালাই নেই। যাচাই করার অবকাশ কোথায়? তাৎক্ষণিক অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। অনেকটা ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ নীতির মতো।
৫. আমি একজন উচ্চশিক্ষিত সাবেক সংসদ সদস্যকে কাছ থেকে জানি, তাঁর সুদীর্ঘ পাঁচ বছরের মেয়াদকালের তিন মাসও গ্রামের নিরীহ শিক্ষিত, সাধারণ মানুষ তাঁর ধারেকাছেও প্রবেশাধিকার পায়নি। তিনি থাকেন নবিশ দুর্বৃত্তায়নের এক কৃত্রিম পরিবেষ্টনের ভিতরে। দুর্ভাগ্য, শুরুতেই তাঁকে কতিপয় সমাজবিধ্বংসী, কম শিক্ষিত, চাঁদাবাজ ও মাদকাসক্ত ঘিরে ফেলে। তিনি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তাঁকে চক্রাকারে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী চাটুকাররা অক্টোপাসের মতো জালে আটকে রাখে। তাঁকে প্রতিদিনকার নিত্যনতুন চিত্রনাট্যে সাজানো নাটকের মাধ্যমে নির্বাক মুগ্ধ শ্রোতা করে তোলে। তারা তাঁকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আর বাইরে তাকাতে দেয়নি। দিনের শেষে তাঁর নিয়তিতে যা হওয়ার তা-ই হলো। তিনি হলেন সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন, ধিকৃত, অনাদৃত এবং একা। সাধারণ মানুষ হলেন চরমভাবে হতাশ। তাঁর নিরাপদ ছত্রছায়ায় অনবরত দুষ্কর্ম করে অবশেষে তারাও অন্য ঘাটে তরি বাঁধল। নিজের অজান্তেই তিনি তৈরি করে গেলেন কতগুলো ফ্রাংকেনস্টাইনের দানব। তিনি এখন হয়তো অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু তাঁর হাতে সে সময় নেই।
৬. চাটুকারিতার জন্য কোনো বড় যোগ্যতা লাগে না, খুব বেশি মেধারও প্রয়োজন পড়ে না। এদের কাছে দেশ, জাতি, মানুষ, দলমত, আদর্শ, নৈতিকতা কিছুরই প্রয়োজনীয়তা থাকে না। এদের মুখের ভাষা ও ব্যবহার প্রায় কাছাকাছি। এরা সব সময় নিরাপদ ও অজাতশত্রু। এদের কাজ সব সময় ক্ষমতার সঙ্গে বসবাস করা। ক্ষমতার স্বাদ না পেলে এরা বাঁচে না। নেতার ইমেজ, সুনাম, সুখ্যাতি তাঁর পরিবার, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুকে মুহূর্তে ধূলিসাৎ করে দিয়ে এরা কেবল নিজেরা বেঁচে থাকতে চায়। চাটুকাররা একসময় তার নিজের নেতার কবর নিজের হাতে রচনা করে। কাজেই সময় এসে গেছে, চারপাশের চামচা ও চাটার দলের কথায় কান না দিয়ে মানুষের কথা সরাসরি শুনুন। মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাদের হৃৎপিণ্ডের ধুকধুক শব্দটা শুনুন। সব পেশার দালাল, সদাহাস্যোজ্জ্বল, ত্রস্তব্যস্ত চাটুকার, বিনয়ের অবতার দুর্নীতিবাজ ও দেশদ্রোহীদের চিহ্নিত করুন, এদের পরিহার করুন। কানকথার মৃত্যু হোক।
লেখক : গল্পকার