১৯ আগস্ট রংপুর গিয়েছিলাম। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থানের মহানায়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ১২তম ব্যাচের ছাত্র আবু সাঈদের কবরে ফাতেহা পাঠ এবং তার পরিবারবর্গের সঙ্গে দেখা করা ও সমবেদনা জানানোর জন্য নেতৃবৃন্দ সাঈদের বাড়ি পীরগঞ্জে যাবেন। দূরের যাত্রা এবং কিছু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি বিমানে সৈয়দপুর নেমে রংপুরে আমার দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে তারাসহ পীরগঞ্জ যাব বলে সিদ্ধান্ত হয়।
ভারত ভাগের অব্যবহিত আগে এবং পরে দিনাজপুর রংপুরের তেভাগা আন্দোলন ছাড়া ওই এলাকার মানুষের উল্লেখযোগ্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস নেই। এবার ২০২৪-এ এসে এক আবু সাঈদ রংপুরকে সারা দেশ তথা বিশ্বের দরবারে গর্বের তিলক পরিয়ে দিল।
অবশ্যই আবু সাঈদ এক আশ্চর্য মহান শিশুর নাম। যেন জাদু মিশে গেছে ওই নামের সঙ্গে। ১৫ বছর শেখ হাসিনার দুর্বিনীত দুঃশাসনে মানুষ পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। জোর করে ক্ষমতা দখল, অর্থ, অস্ত্র এবং ক্ষমতার দাপটে সেই ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা, জনগণের ভোট কেড়ে নেওয়া, রাতের বেলা দিনের ভোট করা; নির্বিঘ্ন, নির্লজ্জভাবে দেশের সম্পদ লুটপাট, প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে জোর করে দমন করা, গুম, খুন আয়নাঘর তাদের শাসনের পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষ কথা বলতে সাহস পাচ্ছিল না। বিরোধী দলগুলো লাগাতার আন্দোলন করছিল ঠিকই কিন্তু কখনোই সাহস নিয়ে ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে এ অবৈধ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। আবু সাঈদ এ চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। কী অমিত তেজে বুক চিতিয়ে দুই বাহু প্রসারিত করে বলেছিলেন, তোমাকে মানি না। গুলি করে মারতে পার আমাকে। কিন্তু আমার কণ্ঠকে, আমার প্রতিরোধকে স্তব্ধ করতে পারবে না। সেই থেকে বাংলার জনগণের সাহসের বাতিঘর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধু বাংলাদেশের নয়; আজ শুনলাম পাকিস্তানে নতুন করে যে ছাত্র গণআন্দোলন গড়ে উঠছে সেখানেও তারা বাংলাদেশের কথা বলছে। বাংলাদেশের জনগণ যেরকম করে অধিকারের প্রশ্নে জীবনপণ লড়াই করেছে তার কথা স্মরণ করছে।
সমবেত রাজনৈতিক কর্মীদের আমি সেই কথা বলছিলাম, আমাদের দলের কার্যালয়ের পাশে কথা বলছিলাম আমি, বেশ কিছু মিডিয়ার সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা বললেন, অবশ্যই আমরা সাঈদের জন্য গর্ববোধ করি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্ন আমাদের মধ্যে আছে, আমরা কি তার মহান আত্মত্যাগের যথাযথ মর্যাদা দিতে পারছি। কথা ছিল প্রতিটি বুলেটের হিসাব নেব আমরা। প্রতিটি মৃত্যুর তদন্ত ও বিচার হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি সাঈদের মৃত্যর তদন্ত করছে পুলিশ, যারা তাকে হত্যা করেছিল। খুনি কখনো বিচারক হতে পারে? খুনের ঘটনার তদন্ত করতে পারে?
পাঠক আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সাঈদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভিডিও ফুটেজ আকারে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপরেও পুলিশ বলেছিল, এটা দুষ্কৃতকারীদের কাজ। তারা ১৭ বছর বয়সের একজন তরুণকে গ্রেপ্তার করেছিল এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে। যদি আন্দোলনের মাধ্যমে হাসিনা স্বৈরাচারের পতন না হতো তাহলে নিশ্চয়ই ওই তরুণ সাঈদ হত্যাকাণ্ডের দায়ে সাজা ভুগত এবং শেখ হাসিনা বলে বেড়াতেন আমি বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি উৎখাত করেছি। সেই পুলিশ যারা ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তারাই আবার সেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবে, তাই কি হয়? আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নের কী জবাব দেব?
ক্ষমতায় থাকার জন্য পতিত স্বৈরাচার পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করেছিল। কত মানুষ মেরেছিল তারা তা এখনো গবেষণার বিষয়। খোদ জাতিসংঘ বলেছে ৬৫০ জন মানুষের মৃত্যুর কথা। আমার ধারণা এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দেশে এবং বিদেশে যখন এ নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা হচ্ছিল তখন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, এরকম হতে পারে না। কারণ পুলিশকে প্রতিটি গুলির হিসাব দিতে হয়। তখন থেকেই দাবি উঠেছিল প্রতিটি গুলির হিসাব দিতে হবে।
৮ আগস্ট নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের এ সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। আমার এ লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হবে ২২ আগস্ট। সে হিসাবে এ দুই সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকার ওপরের স্তরে পুলিশের ব্যাপক পুনর্গঠন করেছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে জাতির উদ্দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনো ভাষণ দেননি। বলেননি কেন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, তিনি বা তারা কী করতে চান, তাদের সরকারের লক্ষ্য কী। অবশ্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে তিনি যা বলেছেন তার নির্গলিতার্থ এরকম দাঁড়ায় : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত আকাক্সক্ষা হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার। তারা সেরকম একটি দেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করবেন। এজন্য ব্যাপক সংস্কার করতে হবে এবং সেই সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরেই তারা নির্বাচন দেবেন।
ক্ষমতা গ্রহণের এই কয় দিনে এ অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের ওপরের স্তরে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। অবশ্য শুধু পুলিশ নয়, সব ক্ষেত্রেই এ সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন তারা। ২১ তারিখে প্রথম আলোর প্রধান শিরোনামে বলা হয়েছে- প্রশাসনিক এ সংস্কারে অনেক সময় লাগবে। একই কথা বলা যায় পুলিশের ক্ষেত্রেও। বরং বেশি করে বলা যায়, ১৫ বছরের স্বৈরাচারে পুলিশ জনগণের ওপর এত অত্যাচার করেছে যে, মানুষ ফুঁসে উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই আমরা পুলিশ কেন, প্রশাসনের কোনো ক্ষেত্রেই আইন নিজের হাতে তুলে দেওয়ার অনুমোদন করব না। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর সবচেয়ে বড় অসহযোগিতা এসেছিল এ পুলিশের কাছ থেকেই। আমরা এ কথা বহুবার বলেছি বাহিনী হিসেবে পুলিশের নিন্দা করি না আমরা; কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য পুলিশের মধ্যে এমনভাবে দলীয়করণ ও কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল যে নিজের বুদ্ধি বিবেচনায় কিছু করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। একই সঙ্গে পুলিশকে সব ধরনের দুর্নীতি করার ও টাকা-পয়সা বানানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। অর্থের লোভে পুলিশকে একটি নির্যাতনের হাতিয়ার বানানো হয়েছিল। এ জন্যই জাতীয় নির্বাচনগুলোতে অবৈধভাবে ব্যালট বাক্স ভর্তি করতে এবং দিনের ভোট রাতে করতে ওদের বুক কাঁপেনি। পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর অনেক কর্মকর্তারা এরকমও বলেছেন যে, এত সুন্দর ভোট তারা আর কখনো দেখেননি।
স্বৈরাচারের পতনের পর তাই পুলিশকে আমরা বাংলাদেশের সড়কে কিংবা থানায় কোথাও দেখিনি। এটাকে কেউ পুলিশ বিদ্রোহ বলেননি। আমরা বুঝেছিলাম পুলিশ শঙ্কিত। সরকারও ব্যাপারটা সেভাবে বুঝেছেন। এবং যথেষ্ট যত্ন ও যোগ্যতার সঙ্গে তাদের আবার কর্মস্থলে ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু তারপরেও কথা থাকে।
পীরগঞ্জ শেষ করে আমি বগুড়ার শিবগঞ্জ গিয়েছিলাম। শিবগঞ্জ আমার বাড়ি। প্রায় ১০ বছর আমি আমার বাড়িতে যেতে পারতাম না। পুলিশ ঢুকতে দিত না। এতদিন পর আমাকে দেখে মানুষ তাদের দুঃখ আবেগ উচ্ছ্বাস সুখ-দুঃখ এবং কষ্টের কথা বলেছে। একটা কথা প্রায় সবাই বলল, এখন আওয়ামী লীগ নাই। কিন্তু প্রশাসন আগেরটাই আছে, আগের মতোই আছে। এখনো থানার প্রভাবশালীরা মানুষের দোকানপাট জমি জিরাত দখল করছে। টাকার বিনিময়ে এবং রাজনৈতিক সাংগঠনিক পরিচিতির জোরে তারা এসব করছে। প্রশাসন তাদের কিছুই বলছে না। নেতারা আগের মতোই ঘুষ দিচ্ছে। ঘুষ দুর্নীতি আগের মতোই চলছে।
যে সংগ্রামে আবু সাঈদরা প্রাণ দিল, জাতিসংঘের হিসাবেই যেটি ৬৫০-এর অধিক, আহত সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার, সেই আন্দোলনের প্রত্যাশা, অভিপ্রায় হলো একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার। এ আকাক্সক্ষা নিয়েই গঠিত হয়েছে এ অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারও এ আকাক্সক্ষার কথাই বলছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. ইউনূসও বলেছেন এ সংস্কার সম্পন্ন করেই তিনি নির্বাচন দেবেন।
এ জন্য দেশের সব ক্ষেত্রে প্রান্তিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় নিয়ে ভাবতে হবে, আশু সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য