মানুষ যেমন বিভিন্ন উপাদান দিয়ে বাসা তৈরি করে পাখিরাও তাই করে। লতা, পাতা, ঘাস বা কাগজ দিয়ে, কেউ তৈরি করে পালক বা রেশম দিয়ে। বাড়ির পাশের আবর্জনা দিয়েও বাসা তৈরি করে অনেক পাখি। কাদা দিয়েও অনেকে বাসা তৈরি করে। যেমন ফ্রেমিঙ্গো। বালু দিয়েও অনেক পাখি তাদের বাসা বানায়। বাসা তৈরিতে মানুষের চেয়ে বিচিত্রতায় পাখিরাই সেরা।
পৃথিবীতে কত রকমের পাখির বাসা আছে তার ইয়ত্তা নেই। পাখির মধ্যে একই নামের বিভিন্ন প্রজাতির পাখির রং চেহারায় অমিল আছে। বিভিন্ন নান্দনিক রঙের মিশ্রণে ভিন্নতা রয়েছে। পাখির বাসার কথার ক্ষেত্রেও পার্থক্য আছে। কিছু কিছু পাখির বাসা তৈরির কৌশলে মারপ্যাঁচ আছে। আমরা অনেকেই নানা রকম পাখির বাসা দেখেছি। এসবের কিছু বাসা নিয়ে কথা বলব আজ। ধরা যাক টিয়ে পাখির কথা- এরা বিভিন্ন বড় গাছে বিশেষ করে তাল, নারিকেলের ফোকরে বাসা তৈরি করে। ফোকর থেকে লাল ঠোঁটে উঁকি দিলে কেমন লাগে? আর টি-টা করতে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলে! ভারী মজা লাগে! প্যাঁচা, কিছু শালিকও গাছের কোটরে বাসা তৈরি করে থাকে। ওহ, কাঠঠোকরার কথা তো বলতেই হবে।
একটা কবিতা পড়েছেন নিশ্চয়ই। রজনীকান্ত সেনের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতা। এখানে বাবুই আর চড়ুই পাখির বাসা নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছে। তাহলে কিছু অংশ তুলেই ধরি আবার- ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই/কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই/ আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে/তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি ঝড়ে...’
বাবুই পাখি আকারে বেশ ছোট, ১৫ সেন্টিমিটার। ওজন ২৮ গ্রাম চড়ুই নিজে বাসা তৈরি করতে পারে না। অন্যের ঘরে বাসা করে বা ছনের চালে বাসা বাঁধে। অট্টালিকা ঘরের কোনো সামান্য তৃণ দিয়ে বাসা তৈরি করে। কিন্তু আরামেই থাকে। আর বাবুইকে শিল্পী পাখি বলা হয়। এরা বহু কষ্ট করে মাঠ থেকে ঘাস বা তৃণ, পাতা ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাসা বানায়। কিন্তু ঝড়ে বহু কষ্ট পায়। তারপরও বাবুই বলে নিজের বাসায় থেকে পরম সুখ।
এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তাই বলি আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখতে হবে। বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখাপেক্ষী হওয়া যাবে না। এর জন্য পড়াশোনা করে ভালো মানুষ হতে হবে।
টুনটুনি আমাদের প্রিয় পাখিদের মধ্যে অন্যতম। এরাও পাতার সঙ্গে পাতা মিলিয়ে সুন্দর বাসা তৈরি করে। ছোট্ট পাখি এরা। এদের ‘দর্জি পাখি’ বলা হয়। টুনটুনি পাখি তার বাসা তৈরি করার আগে দুটি কি তিনটি পাতা সেলাই করে একটা বাটির মতো তৈরি করে, তার মধ্যে নরম ঘাস পাতা দিয়ে সে তার বাসাটি বানায়। সেলাইয়ের সুতা সাধারণত রেশমেরই ব্যবহার করে, কাছে রেশম না-থাকলে যে সুতা পায় তাই দিয়ে করে। সেলাইয়ের সুচ হলো তার সরু ঠোঁট জোড়া। নারিকেলের গাছে বাসা বুনতে ব্যস্ত বাবুই পাখি। তাল, নারিকেল, খেজুর ইত্যাদি গাছের পাতায় বাবুই পাখি বাসা বানায়। শালিকের বাসা কেমন? দেখতে ভালো লাগে না! শুকনা খড়, পাতা, কাগজ দিয়ে ইয়া বড় একখানা বাসা। কিন্তু গাঙশালিকের বাসা? নদীর তীরে মাটির ফোকরের বাসা কিন্তু মন্দ নয়।
দোয়েল অন্য পাখিদের বাসা দখলের ক্ষেত্রে প্রথম বলতে হয়। এরা আবাবিল, কাঠঠোকরা, টিয়া, বসন্তবৌরি ইত্যাদি পাখির বাসা দখল করে বাস করে। আবার নিজেরাও বাসা বানায়। বাসা বানানোর ক্ষেত্রে বোকামি করে। মানুষ চলাচল করে এমন জায়গা বা বন্যপ্রাণীর নাগালেই বাসা করে ফেলে। কিছু পাখি পানিতে থাকে। এদের আমরা জলজ পাখি বলি। যেমন-ডাহুক পাখি ইত্যাদি। জলজ পাখি পানির ওপরে কলমি, শাপলা, পদ্মফুল বা জলজ কোনো উদ্ভিদের ঝোপে খড়কুটো দিয়ে বাসা বানায়। অনেক সময় পানিতে চলমান স্রোতে কলমি বা কচুরিপানার সঙ্গে এসব পাখির বাসাও ভেসে যেতে থাকে।
এবার বলি মাটির তৈরির বাসার কথা। মাটির গর্তে বাসা বানায় মাছরাঙা, গাঙশালিক, কাদাখোঁচা, সুইচোরাসহ জলচর অনেক পাখি। এরা সাধারণত নদীর খাঁড়া পাড়ের মাটিতে ১৪ থেকে ১৮ ইঞ্চি গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এদের বাসায় ঢোকার মুখটা সংকুচিত হলেও ভিতরের ডিম ও বাচ্চা লালন-পালনের স্থানটি অনেক বড়। অনেক জাতের পাখি কাদা দিয়েও তাদের বাসা বানায়, তাদের অধিকাংশই আফ্রিকার। আবার রাজহাঁস মাটির বাসায় থাকতে ভালোবাসে। এরকম কিছু পাখি আছে শুধু বালু, পাথুরে ভূমি এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাটিতে বাসা বানায়। নীল হাঁস, বুনো মুরগি, বুনোহাঁস, অ্যালবাট্টস, গাঙচিল- এরা নিজেদের বাসায় পাখির বুকের নরম পালক, শুকনা জলজ উদ্ভিদ সুন্দর করে বিছিয়ে তাতে ডিম পাড়ে। খোলামেলা মাটিতে বাসা হলেও ঝোপঝাড়, বালুর ঢিবি ও পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে লুকানো বাসাগুলো সহজে নজরে পড়ে না। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট পাখি ‘হামিং বার্ড’-এর বাসা কিন্তু অর্ধেক নারিকেলের খোলের মতোই।
♦ সাংবাদিক, কলামিস্ট