শেয়াল নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতা বহু পুরনো। আমরা যারা গ্রামাঞ্চলে জন্ম নিয়েছি এবং শিশুকাল গ্রামে কাটিয়েছি তাদের কাছে শেয়াল এক আকর্ষণীয় প্রাণী এবং রহস্যময় জানোয়ার। শেয়াল দিনের বেলায় পালিয়ে থাকে এবং রাতের বেলায় বের হয়ে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া বলে ডাকাডাকি করে। জানোয়ারগুলো সাধারণত মুরগি চুরিতে ভীষণ পারদর্শী। ওগুলো দলবেঁধে আখখেতে ঢুকে কৃষকের সর্বনাশ করে অনেকটা বন্য শুয়োরের মতো। মানুষ কিংবা অন্য প্রাণীর সঙ্গে সাধারণ ঝগড়াঝাঁটি দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদে জড়ায় না- তবে মানুষকে একা পেলে ভয় দেখায়, আক্রান্ত হলে হিংস্র হয়ে ওঠে এবং আচ্ছামতো কামড়ে দেয়।
শেয়ালের কামড়ে মানুষ মরে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে মনুষ্য সমাজের কাউকে শেয়াল কামড় দিলে হতভাগ্য মানুষটির ইজ্জত বলে কিছু থাকে না। প্রবহমান বাংলার ছেলে-বুড়ো সবাই দাঁত বের করে আড়ালে-আবডালে শেয়াল আক্রান্ত মানুষটিকে নিয়ে নিরন্তর ঠাট্টা-মশকরা করবেই। সুতরাং শেয়ালের কামড়ের বেদনার চেয়ে মানুষের ঠাট্টা-মশকরার ভয়ংকর পরিণতির কথা স্মরণ করে গ্রামের লোকজন শেয়ালকে ভয় পায়। অথবা শেয়াল থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।
শেয়াল নিয়ে বহু শিশুতোষ গল্প এবং কল্পকাহিনি আমাদের বিমোহিত করে। আমরা শেয়ালকে চালাক-চতুর এবং ধূর্ত প্রাণী হিসেবে ধ্যান-জ্ঞান করি। কেউ কেউ ভক্তির অতিশয্যে শেয়ালকে পণ্ডিত হিসেবে মান্যগণ্য করার পাশাপাশি শেয়ালের তেল, শেয়ালের দুধ কিংবা হাড্ডিগুড্ডির তালাশ করি বিভিন্ন রোগবালাইয়ের অব্যর্থ দাওয়াই হিসেবে। গ্রাম্য বাজারে শেয়ালের তেল বিক্রির মজমা দেখার জন্য শত শত লোক দাঁড়িয়ে থাকে এবং বিক্রেতার মনোহরি গল্পে মুগ্ধ হয়ে এক শিশি তেল কিনে কোন কোন অঙ্গে মাখে, তা কেবল ক্রেতাই বলতে পারে।
আমাদের সামাজিকজীবনে রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও শেয়ালের গুরুত্ব নেহাত কম নয়। আমরা কাউকে বড় করার জন্য যেমন শেয়াল পণ্ডিতের সঙ্গে তুলনা করি, আবার মৃদু সমালোচনার জন্য শেয়ালের প্রসঙ্গ তুলে কাউকে হেয় করার চেষ্টা করি। ফলে আমাদের দেশের বহু মানুষ প্রাকৃতিক রসায়নের কবলে পড়ে বাঘ-সিংহের অভ্যাস কিংবা চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে শেয়াল পণ্ডিতের কয়েকটি অভ্যাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পালিয়ে থাকা, লুকোচুরি করা, ছলচাতুরী করা, দুর্বলের ওপর অত্যাচার কিংবা কাউকে বাগে পেলে একহাত নেওয়া ইত্যাদি কর্মগুলোর সঙ্গে শেয়ালের চরিত্রের এত বেশি মিলমহব্বত রয়েছে যে একই বদগুণ যদি কোনো মানুষের চরিত্রে প্রকট হয়ে পড়ে তবে সেই মানুষটির সঙ্গে শেয়ালের খুব বেশি পার্থক্য থাকে না।
শেয়ালের চরিত্রসম্পন্ন মানুষ যদি রাজনীতিতে অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং কোনোভাবে সিংহাসনে বসে পড়ে সে ক্ষেত্রে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে তছনছ হয়ে যায় তা আমরা ইতিহাসে বহুবার দেখেছি। রাজনীতি রাজার কর্ম এবং রাজার ধর্ম। প্রকৃতির সাহসী প্রাণী বাঘ-সিংহের চরিত্রসম্পন্ন বীর পুরুষ বা বীর নারীরাই এখানে অমরত্ব লাভ করতে পারে। কোনো দুর্বল চরিত্রের সুযোগসন্ধানী কিংবা দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা অথবা ছলচাতুরীতে অভ্যস্ত লোকজন রাজকর্মে একেবারেই অনুপযুক্ত। এ শ্রেণির লোক যদি দুর্ভাগ্যক্রমে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে পড়ে তবে রাজনীতির পরিবর্তে জুয়ানীতি প্রয়োগ করে যে, ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় তা শেষ পর্যন্ত তার জীবনে কতটা নির্মম পরিণতি ঘটাতে পারে এবং দেশ-জাতি রাষ্ট্রের কত বড় সর্বনাশ ঘটাতে পারে তার একটি বিবরণ মহাভারত থেকে আপনাদের জন্য পেশ করছি।
গান্ধার দেশের রাজকন্যা গান্ধারী ছিলেন হস্তিনাপুরের অঙ্গরাজা ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী তাদের বিয়ে হয় এবং বিয়ের পর গান্ধারীর পরিবার জানতে পারে যে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ। গান্ধারীর বড় ভাই শকুনি বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। ফলে ধৃতরাষ্ট্র এবং তার পরিবারকে শেষ করার জন্য তিনি নিজ রাজ্য গান্ধার ত্যাগ করে হস্তিনাপুর চলে এলেন এবং ভগ্নিপতি এবং ভাগ্নে দুর্যোধনকে নানারকম কুপরামর্শ দিয়ে মহাভারতের যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলেন। মহাভারতের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল জুয়াখেলাকে কেন্দ্র করে। শকুনির বুদ্ধিতে দুর্যোধন পঞ্চপাণ্ডরের সঙ্গে জুয়ার প্রতিযোগিতায় নামে এবং জুয়ায় জিতে দ্রোপদিকে লাভ করতে গিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে।
মহাভারতের ঘটনাবলি যারা বিশ্লেষণ করেন তারা সবাই একমত যে দুর্যোধন ছিলেন শেয়ালপ্রকৃতির প্রাণী। জন্মের পরই তার কুলক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রী এবং আত্মীয়স্বজন সবাই পরামর্শ দেন দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করার জন্য। এমনকি দুর্যোধনের মা গান্ধারীও তার জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনের কুকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে রাজাকে পরামর্শ দেন দুর্যোধনকে বনবাসে পাঠানোর জন্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শকুনির পরামর্শ এবং নিজের অন্ধপুত্রস্নেহের কারণে ধৃতরাষ্ট্র তার কুপুত্রকে পরিত্যাগ না করে তাকে যুবরাজ হিসেবে লালনপালন করতে থাকেন যা কি না, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
মহাভারতের উল্লেখিত কাহিনির সঙ্গে যদি আপনি গ্রিক সাহিত্য, আরবি সাহিত্য অথবা শেকসপিয়ারের বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটকগুলোর চরিত্র বিশ্লেষণ করেন তবে দেখতে পাবেন যে শেয়াল চরিত্রের লোকজন যখন রাজনীতির নীতিনির্ধারক হয়ে পড়ে তখন পুরো রাজনীতি, গর্দভের স্বরে প্রকম্পিত হতে থাকে। পৃথিবীর সব ধর্মমত বিজ্ঞান এবং সাহিত্য গর্দভের আচরণকে নির্বুদ্ধিতার সর্বোচ্চ বাস্তব উদাহরণ এবং গর্দভের স্বরকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বিরক্তিকর স্বর বলে আখ্যা দিয়েছে। মহাভারতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, দুর্যোধন যখন জন্ম নিয়েছিল তখন সে গর্দভের স্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে ছিল।
রাজনীতিতে যখন হররোজ এমন সব কথাবার্তা হতে থাকে যা অপ্রয়োজনীয় এবং শুনতে খুবই বিরক্তিকর তখন ধরে নেবেন যে রাজনীতির ময়দান গর্দভের স্বরের কবলে পড়েছে। আপনি যদি দেখেন গর্দভ প্রকৃতির মানুষ মঞ্চে বসে আছে এবং মঞ্চের তলদেশ অথবা অজ্ঞাত স্থান থেকে শেয়ালের হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া রব ভেসে আসছে এবং গর্দভেরা সেই শব্দে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের চিৎকার-চেঁচামেচি বাড়িয়ে দিয়েছে তখন ধরে নেবেন দেশ কাল সমাজে রাজনীতির দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে। সবার শেষে হঠাৎ যদি দেখেন কোনো শেয়াল গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে হঠাৎ মঞ্চে উঠে গেছে এবং গর্দভেরা শেয়ালকে গুরুরূপে তাজিম করে নিজেদের চেয়ার ছেড়ে দিয়েছে তবে ধরে নেবেন রাজনীতিতে কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে।
শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ শুধু শেয়াল নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এবার সিংহ নিয়ে কিছু বলি। বনের রাজা সিংহের ব্যক্তিত্ব, আচরণ, চরিত্র এবং ভাবমূর্তিকে মানুষ আদিকাল থেকেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও কৃতিত্বের সর্বোচ্চ প্রতীকে পরিণত করেছে। মানুষ রাজার যে দরবার বা অফিস সেখানে রাজার আসনকে সিংহাসন আখ্যা দিয়ে আসছে।
রাজার তলোয়ারের হাতলে সিংহের মূর্তি, রাজার প্রাসাদের সামনে সিংহমূর্তি এবং রাজার রাজকীয় সিলমোহর এবং আংটিতে সিংহমূর্তিকে ব্যবহার করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। রাজপ্রাসাদের মূল দরজাকে মানুষ সেই আদিকাল থেকে সিংহ দরজা এবং রাজার হুংকারকে সিংহের গর্জনের সঙ্গে তুলনা করে আসছে। এখন প্রশ্ন হলো, সিংহকে কেন পশুরাজ বলা হয় এবং পশুরাজকে কেন মানুষের রাজার প্রতীকে পরিণত করা হয়েছে!
বনের জন্তু জানোয়ারের মধ্যে একমাত্র সিংহের দুর্লভ কতগুলো গুণাবলি রয়েছে। তারা কাউকে শত্রু মনে করে না। প্রয়োজন ছাড়া ঘোরাফেরা রং-তামাশা শিকার আহার বিহার কিছুই করে না। ক্ষুধা না লাগলে শিকার করে না এবং না খেয়ে মরে গেলেও অখাদ্য খায় না। কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, দলাদলি, মারামারি করে না এবং বিনা প্রয়োজনে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। সিংহ নিজ পরিবার ও বংশের প্রতি দায়িত্বশীল এবং অন্যান্য পশুর প্রতি নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ করে না। প্রকৃতিগতভাবে তার গঠন, আচরণ, জীবনচক্র অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে তুলনীয় নয়। বাঘের যেমন অসংখ্য প্রজাতি রয়েছে এবং বাঘকে বিড়ালের আপগ্রেড ভার্সন মনে করা হয়। পৃথিবীর সর্বত্র শত শত প্রজাতির এবং ভিন্ন ভিন্ন আকার-আকৃতির বাঘ রয়েছে এবং স্থান কাল ভেদে বাঘের আচরণও ভিন্ন। বাঘকে খুব সহজে পোষ মানানো যায় এবং সার্কাসে ইচ্ছামতো নাচানো যায়। কিন্তু সিংহের ক্ষেত্রে ওসব নেই। সারা দুনিয়ায় সিংহ বলতে কেবল সিংহকেই বোঝায় এবং পৃথিবীর নির্দিষ্ট অঞ্চলেই সিংহের বসবাস এবং প্রজনন ঘটে থাকে।
সিংহের শিকার করার পদ্ধতি বাঘের মতো নয়, বাঘ অনেক সময় লুকিয়ে শিকার ধরার ফন্দি আঁটে। কখনো পিছু হটে, আবার বহু ক্ষেত্রে উল্টো আক্রমণের শিকার হয়। অন্যদিকে সিংহের শিকার করার মধ্যে কোনো লুকোচুরি নেই এবং খুব বৃদ্ধ ও অসহায় না হলে সিংহের দিকে চোখ তুলে তাকাতে কোনো প্রাণী সাহস পায় না। একমাত্র হায়েনা ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী সিংহের সামনে যেতে দুঃসাহস দেখায় না। এসব কারণে বনের রাজা এবং মানুষের মনের রাজারূপে আদিকাল থেকে মানুষ সিংহকেই বীরত্বের রাজত্বের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক মনে করে আসছে। আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার সংক্ষেপে শিরোনাম নিয়ে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব।
রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে কিংবা রাজাসনে যখন সিংহ বিক্রমের মানুষের অভিষেক ঘটে তখন সারা দুনিয়ায় একই ফলাফল দেখতে পাওয়া যায়। আমেরিকাতে থমাস জেফারসন, জন এফ কেনেডি, প্রাচীন দুনিয়ায় জারগণ, সাইরাস, দারায়ুস, আলেকজান্ডার, হানিবল, অশোক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রমুখের ইতিহাস কর্মযজ্ঞ এবং মানবধর্ম প্রায় একই রকম। কিন্তু সিংহাসনে যখন শেয়াল প্রকৃতির লোকের অভিষেক ঘটে, তখন সেখানে কেমন ফেরাউনি জমানা, হালাকুর তাণ্ডব, হিটলার, মুসেলিনির যজ্ঞ চলে- তা বোধ করি আপনাদের বুঝিয়ে বলার দরকার পড়বে না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক