লালপুর সাধারণ এক গ্রাম। জেলা শহরের যে এলাকায় আমার বাড়ি সেখান থেকে পৌনে চার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে লালপুর। বর্মা (এখনকার মিয়ানমার) প্রত্যাগত এক ব্যক্তি ওই গ্রামে চা-নাশতা বিক্রির দোকান চালু করেন। বর্মিরা যা খায়, দোকানি নিজ হাতে সেসব খাবার তৈরি করতেন। স্বাদু খাবার। দ্রুত ‘বার্মিজ রেস্তোরাঁ’র নাম ছড়িয়ে পড়ে। নতুনের টানে শহরবাসী নরনারী লালপুরমুখো হতে থাকেন। ‘ওখানে খাব/ওখানে খেতেই হবে’ ভাবতে ভাবতে বছর দেড়েক পার করে দিই। এসে পড়ে এসএসসি পরীক্ষা।
‘সাত দিন পরেই তো ভ্যাজাল শুরু হইব। চল কাইলগা লালপুর যাই, বার্মিজ খাইয়া আসি’- প্রস্তাব করে সহপাঠী আবদুল করিম মিন্টু। পরীক্ষা নামক অনুষ্ঠানটিকে মিন্টু ‘মহাভ্যাজাল’ মনে করে। তবে ভাব প্রকাশের সময় বলে ‘ভ্যাজাল’। যারা পরীক্ষারে ডরায় না তাদের প্রতি সম্মানবশত সে ‘মহা’ কথাটি পরিত্যাগ করে। ভ্যাজাল মানে আসলের সঙ্গে নকলের মিশেলে ‘ভেজাল’ নয়। ভ্যাজাল মানে ঝামেলা, মানে বিরক্তিকর।
বিস্তর আনন্দ প্রাপ্তির সুযোগ অথচ খরচ সীমিত প্রমাণের জন্য আমরা রিকশার সওয়ারি হলাম না। সাইকেলে লালপুর রওনা দিই। যৌথ প্রকল্প। ভাগাভাগির চালনা। একবার মিন্টু চালায়; আমি সাইকেলের পেছনের আসনে বসি। আবার মিন্টু বসে; আমি চালাই। তিনবার চালক আর তিনবার যাত্রী বদল করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছি। রেস্তোরাঁ দেখে মুগ্ধ হতে পারিনি। খড়ে ছাওয়া চালের নিচে দুটি টেবিল। আটজন গ্রাহক নড়বড়ে চেয়ারে কোনোমতে আসীন। আশাহত মিন্টুর মন্তব্য- ‘আল্লাহরে আল্লাহ, হাতির পিঠে বইসা ব্যাঙ দেখতে আইছি নাকি!’
রেস্তোরাঁয় ক্রেতার ভিড় শুরু হয়েছে। খেতে বসে আমরা অনুভব করি হস্তি দর্শনে আমরা পিঁপড়ার পিঠে চেপে এসেছি। মজাদার সব খাবার। পেটভরে খেতে ইচ্ছে হলেও উপায় নেই। তহবিলে টানাটানি। আমরা স্থির করলাম দুই দিন পর আবার এসে খেয়ে যাব। নির্ধারিত দিনে সকাল ১০টায় ফের লালপুর পৌঁছি। কপাল মন্দ। বার্মিজ রেস্তোরাঁ বন্ধ। খুলবে সন্ধ্যায়। দোকানির বাল্যবন্ধুর মা মারা গেছেন। বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে তিনি সাত মাইল দূরে বন্ধুবাড়ি গেছেন। দ্রুত বাড়ি পৌঁছার জন্য আমরা বিকল্প পথে সাইকেল চালাতে থাকি।
পথিমধ্যে টংঘরে স্থাপিত এক দোকানে আমাদের যাত্রাবিরতি। এখানে মুদি পণ্য এবং টিনের পটে ভর্তি ঘনীভূত দুধ দিয়ে বানানো চা পাওয়া যায়। দোকানের সামনে তিন দিকে লম্বা টুল পাতা। তাতে বসা গ্রাহকরা চা খায় আর গভীর নিষ্ঠায় পরচর্চা করে।
আমি আর মিন্টু চায়ের অর্ডার দিয়ে বাঁদিকের টুলে বসলাম। ডানদিকের টুলে বসা তিন ব্যক্তি আমাদের দুজনকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকেন। এদের মধ্যে হালকাদেহী পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকটির থুতনিতে লম্বা লম্বা সামান্য কিছু দাড়ি। থিন পেপারে তৈরি বিড়ি ফুঁকছেন তিনি। বলেন, ‘মার্চাবরা কোন বাড়িতে গেছিলেন?’ মার্চাবরা মানে মাস্টার সাহেবেরা। যারা স্কুল-কলেজে পড়ে, তাদের আমার জেলার নিরক্ষরজনরা ‘মাস্টার সাহেব’ উচ্চারণপূর্বক সম্মান প্রদর্শন করার প্রথা ছিল একসময়।
প্রশ্নকর্তার নাম যে মনসাদ উল্লাহ, তা দুই সঙ্গীর সঙ্গে তার কথাবার্তায় স্পষ্ট হলো। বর্মি খাবার খেতে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছি শুনে মনসাদ বলেন, ‘আল্লায় যা করেন ভালার লাই করেন। খাইতে পাইল্লে তো মনের আনন্দে পাকা রাস্তা দিয়া সাইকেল ছুটাইতেন। তখন তো শর্টকাট পথ ধইরতেন না। আংগো লগে মার্চাবগো দেখাও হইত না।’ এমন সময় মনসাদের পেছনে এসে দাঁড়ায় সুঠামদেহী এক যুবক। বলে, ‘মনসাদ কাগা, কেমন আছেন?’
পেছন ফিরে মনসাদ বলেন, ‘রহমতনি? কিরে ব্যাডা তোর হইছেটা কী? অনেক দিন দেখি না। গেছিলি কোনাই।’ রহমত জানায়, আত্মগোপনে ছিল এত দিন। শুনে মনসাদ যা বললেন তার মর্মার্থ হলো, দুনিয়ার সবাই তো পালিয়ে বেড়ায় না। যে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হয় তার তো পোড়া কপাল। এ ধরনের কপাল যাদের তারা হয় ফুলের মতো পবিত্র, নয়তো বুঝতে হবে তার রয়েছে খবিশের চরিত্র। রহমতের সমস্যাটা কোথায় আপত্তি না থাকলে সে তা খুলে বলতে পারে।
রহমত জানায়, তার বিরুদ্ধে তিনখানা মামলা ঠুকেছেন লোকমান সাহেব। তিনখানাই মিথ্যা মামলা। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য সে গা-ঢাকা দিয়ে থাকে। প্রায় প্রতিদিনই তার খোঁজে পুলিশ আসে বাড়িতে। জবেদ আলীর পুকুরপাড়ের উল্টাদিকের জমির মাটি লোপাট করতে করতে সেখানে পুকুর বানিয়ে ফেলেছেন লোকমান। জবেদ আলী মামলা করে লোকমানের বিরুদ্ধে। মামলায় সাক্ষী হয় রহমত। তাই লাখপতি লোকমান ‘উচিত শিক্ষা’ দিচ্ছেন। মনসাদ বলেন, ‘তুই হইলি গিয়া রাজমিস্ত্রির জোগালি। দিন আইনা দিন খাওনের অবস্থা তোর। লোকমান সাবের তো টাকা গননের লাই অটোমেটিক মেশিন লাগে। ওনার লগে টক্কর দিতে গেছস। মরিচ দিয়া কান চুলকাইলে জ্বালাপোড়া তো সহন লাগে রে বাপ।’
সইবার একটা সীমা থাকে। রহমত আর পারছে না। দুই-তিন দিন পরপর আলতাফ দারোগা আসে আর উঁচু গলায় মাকে বলে, তোমার দাঙ্গাবাজ পোলারে সারেন্ডার করতে বল। লোকমান সাহেবের খামারের তিনটা কর্মচারীর মাথা ফাটাইছে রহমত। ওনার ট্রাকের টায়ার চুরি করেছে। ওনার মাইয়াগোরে জানে মাইরা ফালাবে হুমকি দিচ্ছে। মা বলে, ‘আমার মাসুম পোলা’। জীবনে কাউরে একটা চিমটি পর্যন্ত কাটে নাই। না কইয়া কারও গাছের কাঁচা আম পর্যন্ত ছোঁয় নাই। সেই পোলায় খুনখারাবি করবে বিশ্বাস হয় আপনের?’ দারোগা তখন নিচু গলায় বলে, ‘না। বিশ্বাস হয় না। তবু আসি। আসতে হয়। চাপ আছে। ৫০ টাকা দাও, যাই গা।’
ভরসা দেন মনসাদ উল্লাহ, ‘ঘাবড়াইস নারে ব্যাডা। সন্ধ্যায় চল লোকমান স্যারের বাড়িত। এক্কেরে সোজা ওনার পায়ে পড়বি আর চেহারায় আফসোস আর কান্দনের মিথ্যা ভাব ফুটাইয়া কইবি, ভুল করছি স্যার। মাফ কইরা দেন। বাকিটা আমি সামাল দিমু। বুইঝছসনি?’
মাথা নাড়ে রহমত। হ্যাঁ, কী কী করতে হবে সে বুঝতে পেরেছে।
২. হিমানীর কী কী করতে হবে বলা হয়েছিল। সে সব বুঝেও ছিল। যা যা বুঝেছিল সেই মতো কাজ করাও শুরু করতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা প্রশ্ন আসে তার মাথায়। কেন জানি মনে হয়, সরল সজ্জন নাগরিক যারা তাদেরও কখনো কখনো হিমানীর মতোই প্রশ্নের সমস্যায় ভুগতে হয়। কে এই হিমানী?
সিনেমার নায়িকা হিমানী। প্রশংসনীয় তার অভিনয়। দারুণ রূপসী এই অভিনেত্রীকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন উত্তম দাস। ১৯৯১ সালে কলকাতা হয়ে নয়াদিল্লি যাওয়ার সময় তিন দিন কলকাতায় থেকেছি। ওই সময় জনপ্রিয় স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান উত্তম দাসের একটি অডিও ক্যাসেট কিনেছিলাম। সমাজের নানা রকম অসংগতিকে হাসিঠাট্টার আবরণে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে উত্তমের রয়েছে চমৎকার মুনশিয়ানা। গাইতেও পারেন নিখুঁত। ভারতের বিখ্যাত সব ফিল্ম স্টারের গলা নকল করেন অবিকল।
ক্যাসেটে উত্তমের মুখে বিয়ের আসরে পূজারি ঠাকুর আর কনের ভাইয়ের শিশুপুত্রের মধ্যকার ঘটনাটি আমি বহুবার শুনেছি আর হেসেছি। যাদের শুনিয়েছি তারাও খুব উপভোগ করেছেন। পিসির বিয়ে, দাদু তাকে সমর্পণ করছেন। দাদুর পাশেই বসা ছোট্ট নাতি, বয়স ছয়। ঠাকুর কনের বাপকে বলেন, ‘আমি যা বলব আপনি তা-ই বলবেন। বলুন, আমার মেয়ে প্রভাবতী...।’ সঙ্গে সঙ্গে নাতি বলল, ‘আমার মেয়ে প্রভাবতী...।’ ঠাকুর বলেন, ‘তুমি না খোকা। তোমার দাদু বলবে।’ নাতি বলে, ‘তুমি না খোকা, তোমার দাদু...।’ ঠাকুর বলেন, ‘মহামুশকিল! এই বান্দরটারে এখানে বসালো কে, য়্যাঁ?’ খোকা বলে, ‘মহামুশকিল। এই বান্দরটারে এখানে বসালো কে?’ ঠাকুর বলেন, ‘উঠে যাও খোকা। এখানে তোমার কোনো কাজ নেই।’ খোকা বলে, ‘উঠে যাও। এখানে তোমার কাজ নেই।’ মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় ঠাকুরের, ‘ভাগ্ পাজি ছেলে নইলে কষে চড় মারব তোর কানে। একদম ঠসা হয়ে যাবি।’ খোকাও কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে। রুষ্ট ঠাকুর বললেন, ‘এভাবে চললে তো পাগল হয়ে যাব মশাই!’ খোকা বলে, ‘তো যাও না পাগল হয়ে। বাধা দিচ্ছে কে!’
ক্যাসেটে ‘উদ্ধার’ প্রসঙ্গেও একটা কাহিনি বর্ণনা করেছেন উত্তম দাস। পাহাড়ি এলাকায় ফিল্মের শুটিং চলছে। নায়িকা হিমানীকে দৃশ্য বোঝাচ্ছেন পরিচালক : টিলার ওপর ওই যে ছাতিম গাছ দেখছো, ডান হাতে সেই গাছের কাণ্ড ধরা অবস্থায় তুমি গান গাইবে আর চারদিকে চক্কর দেবে। এমন সময় ভিলেন এসে তোমায় জাপটে ধরে ধর্ষণের চেষ্টা করবে। তুমি চিৎকার করবে ‘বাঁচাও বাঁচাও’। চিৎকার শুনে নায়ক অরবিন্দ গাছের ওপর থেকে লাফ মেরে নেমে এসে ভিলেনের হাত থেকে তোমায় উদ্ধার করবে।
আর ইউ ক্লিয়ার? পরিচালকের প্রশ্ন। নায়িকা হিমানী বলে, ইয়েস স্যার। পরিচালক বলেন, ফাইন! নাউ গো টু দ্যাট ছাতিয়ান ট্রি অ্যান্ড গেট রেডি টু সিং অ্যান্ড সার্কেলিং। নায়িকা চলে যায় টিলার ওপরকার গাছের কাছে। কলাকুশলীরা সবাই যার যার দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। ক্যামেরার পাশে বসা পরিচালক ‘অ্যাকশন’ বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু থেমে গেলেন। কেননা নায়িকা হিমানী টিলার ওপর থেকে দৌড়ে ছুটে আসে পরিচালকের কাছে।
অ্যানি প্রবলেম? জানতে চান পরিচালক। হিমানী বলে, ‘স্যার, চিৎকার শুনে অরবিন্দ এসে ভিলেনের কবল থেকে আমায় উদ্ধার করবে, এই-ই তো!’ পরিচালক বলেন, ‘একজ্যাকটলি।’ হিমানী বলে, ‘এটা তো বুঝলাম। কিন্তু অরবিন্দের কবল থেকে আমায় কে উদ্ধার করবে বুঝতে পারছি না স্যার।’
লেখক : সাংবাদিক