দেশ আজ এক নীরব বিধ্বংসী মহামারির মুখোমুখি। এটি কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া জনিত নয়, মাদকাসক্তির মহামারি। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, ধনী থেকে দরিদ্র, প্রতিটি স্তরে মাদকের এ অক্টোপাস বিষাক্ত থাবা বিস্তার করেছে। ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা কিংবা হালের আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) মতো ভয়ংকর মাদক তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এটি কেবল সামাজিক সমস্যা নয়, অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অশনিসংকেত। এ সমস্যার গভীরতা বুঝতে হলে তাকাতে হবে ভৌগোলিক অবস্থানের দিকে, যা আমাদের এক কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’-এর কেন্দ্রে স্থাপন করেছে।
মাদক কারবারে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ (মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস) এবং ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান) কুখ্যাত। বাংলাদেশের জন্য বড় অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে এর ভৌগোলিক অবস্থান। যা বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে একটি ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ বা ‘অভিশপ্ত ত্রিভুজ’ তৈরি করেছে। এ কুখ্যাত অঞ্চল মাদক উৎপাদনের কেন্দ্র না হলেও, মাদক পাচার ও ব্যবহারের বিশাল বাজারে পরিণত করেছে।

এ ত্রিভুজের সবচেয়ে ভয়ংকর কেন্দ্র মিয়ানমার। মিয়ানমারের শান প্রদেশ, বিশ্বের বৃহৎ ইয়াবা উৎপাদনকারী অঞ্চল। সেখান থেকে উৎপাদিত কোটি কোটি পিস ইয়াবা নাফ নদ পেরিয়ে এবং দুর্গম সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। রোহিঙ্গা সংকট এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে; মাদক কারবারিরা প্রায়ই অসহায় রোহিঙ্গাদের পাচারের কাজে ব্যবহার করছে। টেকনাফ ও কক্সবাজার হয়ে উঠেছে এ মরণনেশার প্রধান প্রবেশদ্বার। ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’-এর কারণে বাংলাদেশ মাদক উৎপাদক দেশ না হয়েও মাদকের বিশাল ভোগবাদী বাজার এবং আন্তর্জাতিক পাচার রুটের ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। এ ভৌগোলিক অবস্থানই মাদক সমস্যার প্রধানতম বাহ্যিক কারণ।
মাদক সমস্যার প্রধান কারণ ভৌগোলিক অবস্থান হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ নানা আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতাসহ কিছু কারণ এ মহামারির বিস্তারে সহায়তা করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব ও হতাশা, সহজলভ্যতা, অতি মুনাফার লোভ, আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচারহীনতা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। মাদকের এ করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পেতে হলে কোনো একক সমাধান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সমন্বিত, বহুমুখী এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা। যার মধ্যে রয়েছে- সরবরাহ হ্রাস : সীমান্তে ‘শূন্য সহনশীলতা’, কূটনৈতিক চাপ, অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট ধ্বংস, ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা, পরিবারের ভূমিকা, সুস্থ বিনোদনের প্রসার, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ, আইনের কঠোর প্রয়োগ, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শুদ্ধি অভিযান।
মাদকের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ কেবল সরকারের একার নয়; এ যুদ্ধ প্রতিটি পরিবারের, প্রতিটি নাগরিকের। ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’-এর ভৌগোলিক অভিশাপ মোকাবিলা করতে হলে আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি জাগ্রত করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধই হতে পারে এ নীরব মহামারি থেকে মুক্তির প্রধান উপায়। আজ যদি আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে মাদকের এ মরণছোবল থেকে রক্ষা করতে না পারি, তাহলে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ার এখনই সময় এবং তা সময়ের দাবিও বটে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী