সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ

ঘুরে ঘুরে মুক্তির গান গেয়েছি...

ঘুরে ঘুরে মুক্তির গান গেয়েছি...

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় নজরুলসংগীত শিল্পী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা শাহীন সামাদ।  মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর গাওয়া গান মুক্তিসেনাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। মহান বিজয়ের মাসে এই শিল্পীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপনে—পান্থ আফজাল

 

বিজয়ের এই মাসে ব্যস্ততা জানতে চাই।

এই মাসে অনেক ব্যস্ত। একা মানুষ আমি! টেলিভিশন, রেডিও ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করেই তো এই বিজয়ের মাস কেটে যায়।

 

বিজয়ের মাস নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?

আসলে এই মাস এলেই মনটা গর্বে ভরে যায়। কারণ, ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে এই মাসে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম। বাঙালি হিসেবে এটি আমার জন্য এটা একই সঙ্গে আনন্দের ও গর্বের। এই দিবসে তাই সবাইকে জানাই অফুরন্ত ভালোবাসা ও অভিনন্দন।

 

আপনি তো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেটা কীভাবে সম্ভব হলো?

তখন ১৪৪ নাম্বার লেনিন সরণিতে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসায় ছিল ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন। সেখানেই দেখা হয় সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, তারেক আলী, মুসাদ আলী, বিপুল ভট্টাচার্য্য, শারমীন মুরশেদ, নায়লা, বুলবুল মহালনবীশ, লতা চৌধুরীসহ আরও অনেকের সঙ্গে। আমাদের সংগঠনের সঙ্গে তখন পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীরা সম্পৃক্ত ছিলেন। শিল্পী সংস্থায় প্রথমে ছিলাম ১৭ জন। পরে হয়ে গেল ১১৭ জন।

 

কোনো সম্মানী পেতেন কি?

অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ছয়টি গান গাওয়ার জন্য  পেয়েছিলাম ১০৫ টাকা। আর যারা গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি থেকে সার্টিফিকেট  দেওয়া হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়সহ অনেকেই ছিলেন তখন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সঙ্গে। গান গেয়ে যে সম্মানী পেতাম তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা-শরণার্থীদের জন্য হাঁড়ি-পাতিল, খাবার, পানি, কম্বল কেনা হতো।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে আপনারা শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে গান করেছেন...

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৮। আমাদের কাজ ছিল শরণার্থী ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান গাওয়া। আমরা পুরো নয় মাস পশ্চিমবঙ্গেই ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। মঞ্চ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আমাদের গান গাওয়ানো হতো। আমরা দিল্লিতেও এক মাস ছিলাম, যেখানে আমাদের কাজ ছিল শুধু গান গাওয়া ।

 

মুক্তিযোদ্ধা তালিকার সঠিক দলিল আছে কি?

আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক দলিল বলতে  তেমন কিছুই নেই। আমরা যারা গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি সেটা ২৪ বছর পর উদ্ধার হয়। তারেক মাসুদের মুক্তির গানের পর সবাই জানলেন যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। সব দলিলে, তথ্যে ফাঙ্গাস পড়ে গিয়েছিল। এখন তো অনেক মুক্তিযোদ্ধা জমে গেছেন, যারা সে সময় সম্পৃক্ত ছিলেন না।

 

মুক্তির গানের সঙ্গে কারা যুক্ত ছিলেন?

সে সময় মুক্তির গানে আমি ছাড়াও আমাদের সংগঠনের শারমীন সুলতানা, স্বপন চৌধুরী, দেবু চৌধুরী, লতা চৌধুরী, নায়লা যুক্ত ছিল। সংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন সানজিদা আপা, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান। মুক্তির গানের শুটিংটা ছিল অনেক কষ্টের। একটা ভাঙা ট্রাকে করে ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম। কষ্টের ছিল সেটি।

 

‘রূপান্তরের গান’ নিয়ে জানতে চাই...

‘রূপান্তরের গান’ নামে আমাদের একটি স্ক্রিপ্ট ছিল। ‘রূপান্তরের গান’ শিরোনামে সাজানো হয়েছিল মুক্তি ও সংগ্রামী চেতনার গানগুলো। এটার স্কেচ করতেন মুস্তাফা মনোয়ার ও স্ক্রিপ্ট পড়তেন সৈয়দ হাসান ইমাম। অনেক অনুষ্ঠান করেছি। এই পাড়ের সব গুণী শিল্পীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কলকাতারও অনেক গুণী শিল্পী। গণসংগীতের সঙ্গে গাইতাম ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ প্রভৃতি।

 

ছায়ানটের সঙ্গেও তো আছেন...

স্বাধীনতার আগে থেকেই যুক্ত। বাবা ছায়ানটে ভর্তি করে দিয়ে সেই সালেই মারা যান। ৪৬ বছর ধরে সঙ্গে আছি এবং আজীবন থাকব।

 

অপ্রাপ্তি আর আক্ষেপ...

না, প্রাপ্তি আছে। জীবদ্দশায় দেশের মানুষের কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি। এটাই আমার বড় পাওয়া। আর আমি মূলত নজরুলসংগীত ও পঞ্চকবির গান করে থাকি; দেশের গান তো করিই। কিন্তু দুঃখ একটাই যে, নজরুলসংগীত নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ খুবই কম। অনেকেই স্পন্সর করতে চায় না। এদিকে তাই রাষ্ট্র, বিভিন্ন স্পন্সর, প্রযোজনা সংস্থার জোরালোভাবে এগিয়ে আসা উচিত।

সর্বশেষ খবর