বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ফরীদিবিহীন আরেক বসন্ত

পান্থ আফজাল

ফরীদিবিহীন  আরেক বসন্ত

ভাবনার বারান্দায় অতীতের চিরচেনা ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রের সেই কুটিল ব্যক্তির ছবিটি ভেসে বেড়ায় কখনো? যিনি বাংলাদেশের মঞ্চ, টিভিনাটক ও চলচ্চিত্র ইতিহাসে চিরভাস্বর এবং অবিসংবাদিত অভিনেতা। নাম হুমায়ুন ফরীদি। আজ এই কিংবদন্তির প্রয়াণের আট বছর হলো। এইদিনে বুকভরা অভিমান নিয়ে চিরতরে চলে গেছেন তিনি। অসামান্য মেধাবী ও জাঁদরেল এই অভিনেতার এদেশে জন্মটাই ছিল সব মেধা উজাড় করে দেওয়ার; প্রাপ্তিটা যেন ধোঁয়াশা! সংশপ্তক নাটক প্রচারের অনেক আগে থেকেই হুমায়ুন ফরীদি মঞ্চ এবং টিভি নাটকের শীর্ষস্থানীয় অভিনেতা ছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে বেশির ভাগ মানুষই বোধহয় ‘কানকাটা রমজান’কেই পছন্দ করবেন। ভয়ঙ্কর কুটিল, ধুরন্ধর এবং একই সঙ্গে কিছুটা কমেডি ধাঁচের রমজান চরিত্রটি ভার্সেটাইল এই অভিনেতা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার কোনো তুলনা হতে পারে না। ব্ল্যাক কমেডির সার্থক চিত্ররূপ বলা যেতে পারে নাটকে তার অংশটুকুকে। নব্বইয়ের গোড়া থেকেই হুমায়ুন ফরীদির বড় পর্দার লাইফ শুরু হয়। সেখানেও তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। নায়ক-খলনায়ক দুই চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল। মানুষ নায়ককে নয়, এক ভিলেনকে দেখতেই একসময় হলে যেতেন। হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে কাজের স্মৃতি জিজ্ঞাসা করতেই নিমা রহমান বলেন, ‘আমি ছিলাম ফরীদির প্রথম নায়িকা। ফরীদি খুব কাতুকুতু স্বভাবের ছিল। ফরীদিকে জড়িয়ে ধরা যেত না, কাতুকুতুর ব্যারাম ছিল। সে সর্বদাই ছিল হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণখোলা, পাগলাটে স্বভাবের। সব সময় জোকস বলত।’ ফরীদিকে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করে ম্যাজিকম্যান জুয়েল আইচ বলেন, ‘ফরীদি আমার জীবনের জন্য প্রচ- একটা কষ্টের নাম। হুমায়ুন ফরীদি কেন যে আমাকে এত ভালোবাসত জানি না! ফরীদির তখনো পয়সাপাতি হয়নি। একদিন দাওয়াত করল। বলল, বন্ধু! তুমি আমার বাসায় আসবে, একসঙ্গে খাব। তুমি কী খেতে পছন্দ কর? বললাম, সবই তো খাই। সে বলল, তবুও বল। বললাম, মাছ আর ডাল হলে মহাখুশি। তারপর নির্দিষ্ট দিনে গেলাম। ওমা, গিয়ে তো চোখ ওপরে ওঠার মতো অবস্থা! এমন কোনো মাছ নেই যে, সে দুটো খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখেনি। এর মধ্যে এমন এমন মাছও আছে যেগুলো আমরা ছোটবেলায় কাদার মধ্যে ধরতাম। বললাম, একি করছ পাগল? সে বলল, বন্ধু তুমি তো বলেছ মাছ খেতে পছন্দ কর, তাই এই আয়োজন। পরে জেনেছি, সে ভোর রাতে উঠে ঢাকা শহরের সব জায়গা ঘুরেছে। যত মাছ দেখেছে তা থেকে কিছু কিছু কিনেছে।’ হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে দারুণ সখ্যতা ছিল তারিক আনামের। ‘হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে তো প্রতিটি মুহূর্তই মজার। অ™ভুত স্বভাবের ছিল সে। ও সবসময় আউট অব দ্য ফ্রেম থাকতে চাইত। ও ওর ইচ্ছামতো চলত। ভালো লাগলে চাকরি করত, না লাগলে ছেড়ে দিয়ে চলে আসত। কথা নাই, বার্তা নাই বলে বসল, কাল থেকে আমি আপনার অফিসে জয়েন করছি। সে চাকরি, ব্যবসা করার ট্রাই করেছে, তবে সেই পাগলামোর কারণে বেশিদিন করতে পারত না। ফরীদি পুরোটাই একজন অ্যাক্টর। অ্যাক্টিং করা ছাড়া ও আর কিছু করতে পারত না। তাই অ্যাক্টর হিসেবে যদি কাউকে হিংসে করতে হয় সেটা ফরীদিকে নিয়ে। কিংবদন্তিরা বেঁচে থাকে ভালোবাসায়। তাদের কোনো মৃত্যু নেই, শুধু হয় শারীরিক সমাপ্তি। কর্ম তাদের বাঁচিয়ে রাখে হাজারো মানুষের মনে। ফরীদিবিহীন বসন্তের দিনগুলোতে গাঁদা ফুলের উজ্জ্বলতা ও গোলাপের ঘ্রাণ অন্তত আমাদের জন্য কিছুটা ম্লান ও ধূসর। ব্যক্তিজীবনে অসম্ভব অভিমানী এই শিল্পী জীবনকে পিষে-ঘষে-পুড়িয়ে জীবন ধরার চেষ্টা করে গেছেন। এখনো চোখ মুদলে তার অট্টহাসিতে কাচ ভাঙার শব্দ শুনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর