শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

দেব-সুরাইয়ার প্রেম কাহিনি

দেব-সুরাইয়ার প্রেম কাহিনি

বলিউডের রোমান্টিক নায়কদের মধ্যে দেব আনন্দ অন্যতম। অগণিত নারীহৃদয়ে দোলা দিয়েছেন তিনি। দেব আনন্দের মনে চিরদিনের মতো যিনি দাগ কেটেছিলেন তিনি হলেন অভিনেত্রী সুরাইয়া। যদিও এ প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি ছিল বিয়োগান্তক। তাদের বেদনাবিধুর প্রেম কাহিনির কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

প্রথম দেখা

দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রথম দেখা হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষ দিকে। তখন দেব সবে পা রেখেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। চেষ্টা করছেন পরিচিতি পাওয়ার। অন্যদিকে সুরাইয়া তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। নায়িকা ও গায়িকা হিসেবে তিনি তখন প্রথম সারিতে। নায়িকা সুরাইয়ার রূপ ও গুণে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হন দেব। সব থেকে ভালো লেগেছিল নায়িকার ‘ডাউন টু আর্থ’ মনোভাব। আর তাতে সুরাইয়ায় মজেন দেব। তাদের পরিচয় পর্বটি ছিল বেশ নাটকীয়। বোম্বে থেকে ট্রেনে পুণে যাচ্ছিলেন দেব। তার সঙ্গে একই কামরায় ওঠেন সুরাইয়া। দেব মুগ্ধ হন তার অসাধারণ রূপ ও কণ্ঠে। পরে কাজের সূত্রে আলাপ জমে ওঠে তাদের। চলচ্চিত্রে সংলাপ বলার সময় নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করতেন তারা। অভিনয়ের ছলে ভালোবাসার আলাপন চলত তাদের।

 

যেভাবে প্রেমের সূচনা

ভালোলাগার মানুষ মানে সুরাইয়ার সঙ্গে এলো অভিনয়ের সুযোগ। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রথম জুটি বাঁধা ছবি ‘বিদ্যা’। ছবিতে ‘কিনারে কিনারে চলে যায়েঙ্গ’ গানের শুটিংয়ের সময় নৌকা উল্টে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন সুরাইয়া। প্রাণের ঝুঁঁকি নিয়ে তাকে বাঁচান দেব আনন্দ। এ ঘটনায় সুরাইয়ার মনের গভীরে গেঁথে যান দেব। এক স্মৃতিকথায় সুরাইয়া বলেন, দেব আনন্দের ব্যক্তিত্বের সাদাসিধে দিকটাই তাকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রাণরক্ষার পরে সুরাইয়া বলেছিলেন, ‘তুমি যদি না বাঁচাতে, আজ আমার জীবন শেষ হয়ে যেত।’ শুনে নাকি দেব আনন্দ বলেছিলেন, ‘তোমার জীবন শেষ হলে সেইসঙ্গে আমারটাও শেষ হয়ে যেত।’ এরপর দুজনের সম্পর্ক গাঢ় হতে আর দেরি হয়নি।

 

বাঁধনহারা প্রেম

দেব-সুরাইয়া জুটির সাতটি ছবি মুক্তি পায়। ‘বিদ্যা’(১৯৪৮), ‘জিত’ (১৯৪৯) এবং ‘শায়ের’ (১৯৪৯) সুপারহিট হয়। এছাড়া আরও দুটি ছবি মুক্তি পায় তখন। এগুলো হলো- ‘দো  সিতারে’ ও ‘সনম’। এ জুটি। দীর্ঘদিন সময় লুকিয়ে প্রেম করলেও ১৯৫০ সালে ‘আফসার’ ছবির সেটে অনেকেরই নজরে পড়ে যান তারা। তখন দুজন মাঝে মধ্যে হাওয়া হয়ে যেতেন কিংবা স্টুডিওর ভিতরেই খুঁজে নিতেন নিরালা কোনো জায়গা। প্রেমের ইতিবাচক ছাপ পড়ে দুজনের ওপরেই। দেবের অভিনয়ে পরিপক্বতা আসে। সুরাইয়ার কণ্ঠে দেখা দেয় নতুন মাধুর্য। সিনেমার শুটিংয়ে যখন তারা প্রেমের অভিনয় করতেন তখন ইউনিটের সবাই টের পেত তাদের ভালোবাসা। এভাবেই চলছিল তাদের বাঁধনহারা প্রেম পর্ব।

 

দেব যে কারণে গ্রেগরি পেক

দেব আনন্দকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার ‘গ্রেগরি পেক’। শোনা যায়, প্রেয়সী সুরাইয়ার মন জয় করতেই তিনি গ্রেগরি পেক-কে অনুসরণ করতেন। কারণ গ্রেগরি পেক ছিলেন সুরাইয়ার প্রিয় অভিনেতা।

 

ধর্মই প্রেমের বাধা

হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেব আনন্দ আর মুসলিম সুরাইয়ার প্রেমের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল ধর্ম। দুই বছর নিজেদের প্রেমের সম্পর্ক গোপন রেখেছিলেন দেব-সুরাইয়া। জানতেন শুধু ইন্ডাস্ট্রির ঘনিষ্ঠজন। ১৯৫০ সালে ‘আফসার’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় তাদের প্রণয় প্রকাশ্যে আসে। তার আগে একবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন দুজনে। ১৯৪৯ সালে ‘জিৎ’ ছবির শুটিংয়ের সময় পালিয়ে গিয়ে বিয়ের করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তারা। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহঅভিনেত্রী দুর্গা খোটে। কিন্তু এক সহপরিচালক এ খবর জানিয়ে দেন সুরাইয়ার বাড়িতে। তার দিদিমা এসে সেট থেকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুরাইয়াকে। সুরাইয়ার পরিবারে তার দিদিমা বাদশা বেগম ও মামার মারাত্মক প্রভাব ছিল। কার্যত দোর্দ-  প্রতাপ দিদিমা-ই ছিলেন সংসারের শেষ কথা। তিনি কোনোমতেই নাতনির সঙ্গে দেব আনন্দের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। কারণ, সংসারের মূল উপার্জনক্ষম সুরাইয়ার বিয়ে দিতে তারা রাজি ছিলেন না। পাশাপাশি, রক্ষণশীল বাদশা বেগম মেনে নিতে পারেননি একজন ভিন্নধর্মী তাদের পরিবারের জামাই হবে।

 

আবারও বিয়ের উদ্যোগ

১৯৫০ সালে মুক্তি পায় তাদের ছবি ‘নীলি’। শুটিং সেটে সুরাইয়াকে আরও একবার বিয়ের প্রস্তাব দেন দেব। পালিয়ে গিয়ে বিয়েতেও কোনো আপত্তি ছিল না তার। কিন্তু সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে রাজি হননি সুরাইয়া। রাগে জ্ঞান হারিয়ে সুরাইয়াকে চড় মেরেছিলেন দেব আনন্দ। বলেছিলেন, ‘সুরাইয়া ভীতু ও কাপুরুষ।’ পরে এ ঘটনার জন্য বারবার ক্ষমা চান অনুতপ্ত দেব আনন্দ। পরের বছর সুরাইয়াকে হীরার আংটি দিয়ে প্রোপোজ করেন দেব আনন্দ। সেটি অনামিকায় পরেও ফেলেন সুরাইয়া। তবে সেই আংটি তার দিদিমার নজর এড়ায়নি। এমনকি, তিনি যখন জানতে চান, সুরাইয়া সত্যি কথাই বলেন। ওই আংটি তার হাত থেকে খুলে নিয়ে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেন বাদশা বেগম।

 

ফের বাধা

এক পর্যায়ে দেব-সুরাইয়া দেখা সাক্ষাৎও বন্ধ করে দেন বাদশা বেগম। কামিনী কৌশলের মতো বন্ধুর হাত দিয়ে তারা একে অন্যকে চিঠি পাঠাতেন। দেব আনন্দের ফোন এলেও সুরাইয়াকে ধরতে দেওয়া হতো না। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে অভিনয়ও। ১৯৫১ সালে মুক্তি পেয়েছিল দেব আনন্দ-সুরাইয়া জুটির শেষ ছবি ‘সনম’।

 

দেবকে হত্যার হুমকি

তাদের সম্পর্কে সায় ছিল সুরাইয়ার বাবা মায়ের। কিন্তু দিদিমা বাদশা বেগমের বিরুদ্ধাচরণ তারা করতে পারেননি। দেব আনন্দও বলেছিলেন তিনি ভালোবাসা ছাড়া কোনো ধর্মকে মানেন না। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি সুরাইয়া নিজেই। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন অপারগতার কথা। দেব আনন্দকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন সুরাইয়ার দিদিমা ও মামা। এরপর সুরাইয়া নিজেকে এ সম্পর্ক থেকে সরিয়ে নেবেন বলে স্থির করেন। তিনি চাননি, তার জন্য দেব আনন্দের কোনো ক্ষতি হোক।

 

লুকিয়ে শেষ দেখা

তবু দেব আনন্দ আসতেন তার প্রেয়সীর সঙ্গে দেখা করতে। সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা করতেন বাড়ির ছাদে। সেখানেই তাদের শেষ দেখা হয়েছিল। বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সুরাইয়ার মা। বাড়ির পেছনের পানির পাইপ বেয়ে দেব উঠতেন ছাদে। সন্ধ্যার অন্ধকারে পানির ট্যাংকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন সুরাইয়া। অশ্রুভেজা চোখে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরতেন তারা। এক সন্ধ্যায় চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন তারা একে অপরের কাছ থেকে। শেষ হয়ে গিয়েছিলে দুজনের চার বছরের সম্পর্ক। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া দেব আনন্দের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার দাদা চেতন আনন্দ। পরামর্শ দিয়েছিলেন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে অভিনয়ে মনোনিবেশ করতে।

 

দেবের বিয়ে এবং অসুখী জীবন

দেব আনন্দ বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৪ সালে। বিয়ে করেন ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ সিনেমায় তার সহঅভিনেত্রী কল্পনা কার্তিককে। তার আসল নাম ছিল মোনা। তার প্রোডাকশন হাউস নবকেতন ফিল্মসের কর্মী মোনা সিংহ ওরফে কল্পনা কার্তিককে ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করলেও দেবের দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখের হয়নি। সুরাইয়ার প্রতি প্রেমই তার প্রধান কারণ। নামকরা নায়ক, নির্মাতা দেবের জীবনে সুন্দরী নায়িকার আনাগোনা কম ছিল না। তার হাত ধরে চলচ্চিত্রে পা রেখেছেন জিনাত আমান, হেমা মালিনীর মতো সুন্দরীরা। কিন্তু সুরাইয়াকে তিনি কখনোই ভুলতে পারেননি। এক ছাদের নিচে বসবাস করলেও মোনার সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা তার কখনো হয়নি। অভিনেত্রী তথা সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন তিনি। জীবনে যতবার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বেশিরভাগ সময়েই মুখোমুখি হয়েছেন সুরাইয়া-প্রসঙ্গের। কখনো প্রশ্ন এড়িয়ে যাননি। উজাড় করে দিয়েছেন সুরাইয়ার সঙ্গে তার যত স্মৃতি।

 

একাই রয়ে গেলেন সুরাইয়া

দেব আনন্দ এক সময় সুরাইয়াকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম হলো প্রেম। সামাজিক কিংবা পারিবারিক বাধাকে তোমার হৃদয়ের ওপর স্থান দিও না।’ কিন্তু সুরাইয়া শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে মনের মানুষকে বিয়ে করতে পারেননি। এ সিদ্ধান্ত না নিতে পারার যন্ত্রণায় সুরাইয়া সারা জীবন অনুতাপ করেছেন। দেবের বিয়ের পর ভগ্ন হৃদয়ের সুরাইয়া আশ্রয় খুঁজেছিলেন মায়ের মধ্যে। দেব আনন্দের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর কমিয়ে দেন ছবিতে অভিনয়। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় তার শেষ ছবি ‘রুস্তম সোহরাব’। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন সুরাইয়া। আর চিরসবুজ দেব আনন্দ প্রয়াত হন ২০১১-সালের ৩ ডিসেম্বর।

 

সুরাইয়ার অনুতাপ

দেবকে হারিয়ে চরম নিরাশায় ডুবে যান সুরাইয়া। ১৯৬৩ সালের পর আর অভিনয় করেননি তিনি। দেবকে হারিয়ে সুরাইয়া অবিবাহিত ছিলেন সারা জীবন। মা, বাবা, নানীর মৃত্যুর পর আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। তার আত্মীয়রা ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান। বোম্বেতে রয়ে যান শুধু সুরাইয়া। ছিলেন খুব নিভৃতচারী। চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট কোনো অনুষ্ঠানে যেতেন না। গানের জগৎও ত্যাগ করেন। সত্তরের দশকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দেবকে প্রত্যাখ্যান করা ছিল তার জীবনের চরম ভুল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ ভুলের জন্য অনুতাপ করতে হবে তাকে।  দেব আনন্দ-সুরাইয়ার প্রেমকাহিনি এখনো হিন্দি সিনেপাড়ায় বিষাদময় হয়ে গাঁথা হয়ে রয়েছে।

সর্বশেষ খবর