সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে বর্ণাঢ্য প্রচারণার ব্যবস্থা করা হতো। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রচারণার চিত্র চলচ্চিত্রপাড়া থেকে বলতে গেলে উধাও। প্রবাদ আছে প্রচারে প্রসার। কমপক্ষে গত দুই ঈদে ছবির নির্মাতা ও শিল্পীদের মধ্যে এই প্রবাদের যথার্থতা বুঝতে দেখা যাচ্ছে। সবাই ছুটে চলছেন এক সিনেমা হল থেকে অন্য সিনেমা হলে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। রাতদিন নির্ঘুম ব্যস্ত তারা ছবির প্রচারে। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে যথেষ্ট।
‘চলচ্চিত্রের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে। ঝিমিয়ে পড়া চলচ্চিত্র নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। এটাই এখন বাস্তবতা। কমপক্ষে গত দুই ঈদে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শক আগ্রহ এবং সিনেমা হলে দর্শকের জোয়ার দেখে আবার প্রমাণ হলো মানসম্মত ছবি পেলে দর্শক সিনেমা হলে আসবেই। দেশি ছবি দেখবেই। চলচ্চিত্রের এই বহমান প্রাণ ধরে রাখতে ভালো ছবি নির্মাণের বিকল্প নেই।’ বলছেন প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ।
গত কোরবানির ঈদে মুক্তি পেয়েছে তিনটি সিনেমা। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ-ইরান যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত অনন্ত জলিল-বর্ষা জুটির সিনেমা ‘দিন : দ্য ডে’, রায়হান রাফি পরিচালিত শরিফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা মিম ও ইয়াশ রোহান অভিনীত ‘পরাণ’ এবং অনন্য মামুন পরিচালিত রোশান-পূজা অভিনীত সিনেমা ‘সাইকো’। এই তিন সিনেমার মধ্যে ‘দিন : দ্য ডে’ ও ‘পরাণ’ দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে এবং আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সিনেমা হলগুলোর সামনে দর্শকের ভিড় এবং রীতিমতো টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ির মতো ঘটনাও ঘটেছে। হাউস ফুল গেছে শো। মুক্তির এতদিন পরও ঈদের সিনেমা দেখতে এখনো মানুষ প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছেন। করোনা মহামারির পর বাংলা সিনেমার প্রতি দর্শকদের এমন আগ্রহ বেশ ইতিবাচক মনে করছেন সিনেমা-সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, নতুন করে যেন বইতে শুরু করেছে চলচ্চিত্রে সুবাতাস। এর পেছনে কারণও রয়েছে। ঢাকাই সিনেমায় আলোচিত জুটি অনন্ত জলিল-বর্ষা দীর্ঘ আট বছর পর পর্দায় ফিরেছেন। তাও আবার ১০০ কোটির সিনেমা দিয়ে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এত বড় বাজেটের সিনেমা এর আগে মুক্তি পায়নি। যেটি বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর ‘দিন : দ্য ডে’র প্রচারণাও ছিল ব্যাপক। শহর, জেলা ও মফস্বলের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ হলে হলে সর্বত্রই পৌঁছানোর জন্য সবটুকু চেষ্টাই করেছেন অনন্ত জলিল। অন্যদিকে ‘পরাণ’ও দাপটের সঙ্গে চলেছে। বাজেট কম হলেও ‘দিন : দ্য ডে’র সঙ্গে বেশ ভালোই টক্কর দিয়েছে ‘পরাণ’। ‘দিন : দ্য ডে’ সিনেমায় বাজেট, লোকেশন, বিদেশি শিল্পী ও প্রযুক্তির ব্যবহার থাকলেও ‘পরাণ’ এগিয়ে ছিল গল্প, অভিনয় ও সুনির্মাণের কারণে। বিদ্যা সিনহা মিম এখানে নতুন করে নিজেকে চিনিয়েছেন। আর শরিফুল রাজ অনবদ্য অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেছেন। নতুন এই নায়কে সবাই রীতিমতো বুদ হয়েছেন। অন্যদিকে ‘সাইকো’র পরিচালক অনন্য মামুন দাবি করেছেন ঢাকার বাইরে তাঁদের সিনেমাটি বেশ ভালো চলেছে। ‘পরাণ’ ছবিটি শুরুতে স্বল্পসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে তার চার গুণ বেড়ে ৫৫ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। এবার এলো নতুন খবর। এ সিনেমা যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া-কানাডাসহ আটটি দেশে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। বিষয়টি জানিয়েছেন সিনেমাটির প্রযোজনা সংস্থা লাইভ টেকনোলজিসের পরিচালক ইয়াসির আরাফাত। এদিকে আবার চলচ্চিত্রে নতুন করে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আগে চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েই ছবিটির নির্মাতা ও শিল্পীরা তাঁদের দায় সারতেন না। সিনেমা হলে দর্শক ফেরাতে বর্ণাঢ্য প্রচারণার ব্যবস্থা করা হতো। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রচারণার চিত্র চলচ্চিত্রপাড়া থেকে বলতে গেলে উধাও। প্রবাদ আছে প্রচারে প্রসার। কমপক্ষে গত দুই ঈদে ছবির নির্মাতা ও শিল্পীদের মধ্যে এই প্রবাদের যথার্থতা বুঝতে দেখা যাচ্ছে। সবাই ছুটে চলছেন এক সিনেমা হল থেকে অন্য সিনেমা হলে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। রাতদিন নির্ঘুম ব্যস্ত তাঁরা ছবির প্রচারে। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে যথেষ্ট। সিনেমা হলে দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আবার। অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে টিকিট। যদিও সিনেমা হল সংকট রয়েছে, তবুও একাধিক মাধ্যমের ভিতর দিয়ে চলচ্চিত্রের ব্যবসা ফেরানোর তাগিদ কাজে লাগছে অনেকটাই। দেশি ছবির প্রতি দর্শক ফেরানোর এই প্রাণান্তকর চেষ্টার সুফল শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও পাওয়া যাচ্ছে। রমজানের ঈদে মুক্তি পাওয়া শাকিব-পূজা অভিনীত এস এ হক অলিক পরিচালিত ও খোরশেদ আলম খসরু পরিচালিত ‘গলুই’ ছবিটি দেশে দর্শক মন কাড়ার পর ঈদুল আজহায় যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পেয়ে সেখানকার দর্শকদের মন মাতাচ্ছে এখনো। ঢালিউডের শীর্ষনায়ক শাকিব খান বলেন, মানসম্মত ছবি পেয়েছে বলেই এসব ছবির প্রতি দর্শক উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে। ‘গলুই’ ছবিতে কোনো অ্যাকশন বা আইটেম নাচ নেই। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং নিটোল প্রেমের একটি সুনির্মল ছবি পেয়েছে বলেই দেশ-বিদেশের দর্শক ছবিটিকে সাদরে গ্রহণ করেছে। এটি আমাদের দৈন্যদশায় থাকা চলচ্চিত্রের জন্য একটি আশাজাগানিয়া দিক। ভালো ছবি নির্মাণের মাধ্যমে দর্শক আগ্রহের এই ধারা বজায় রাখতে হবে। এদিকে আগামী শুক্রবার মুক্তি পেতে যাচ্ছে মেজবাউর রহমান সুমনের চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’। ছবিটি নিয়ে এর নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা স্থানে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা ছবির দর্শকদের হলে ফেরানোর এই প্রাণান্ত চেষ্টা নিয়ে একাধিক সফল ছবির নায়ক চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আমাদের দিক থেকে কার্পণ্য করি না। বরং শিল্পী-কলাকুশলীরা নিজেদের ছবির প্রমোশনের জন্য অনেক কিছুর সেক্রিফাইস করেন। এখন প্রয়োজন গোটা ব্যবস্থাপনা ঠিক করা। কারণ যে কোনো বাণিজ্যে আপনি লাভ দেখাতে পারলে সেই ব্যবসায় সবাই আগ্রহী হবেই।’ উল্লেখ্য, ‘হাওয়া’ ছবির ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি এখন মুখে মুখে ফিরছে। এসব কারণে দর্শক ছবিটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অনেক সিনেপ্লেক্সে ইতিমধ্যেই ছবিটির টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে। আশার বিষয় হলো, মধ্যবিত্ত পরিবার, স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়ে আবারও হলমুখী হচ্ছে। কিনছে নিজেদের পছন্দের ছবির টি-শার্ট। তাই এই কৌতূহলের ঢেউ ঠিক থাকলে সিনেমার সুদিন আসতে খুব বেশি দেরি হবে না বলে চলচ্চিত্রকাররা আশায় বুক বাঁধছেন। পরাণ ছবির প্রযোজক ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘দেশের বাইরে ‘পরাণ’ দেখার জন্য দর্শকরা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিদেশি পরিবেশকরা ‘পরাণ’ প্রদর্শন করতে চাইছেন। শিগগিরই ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, লন্ডন, ওমান, দুবাই, কানাডায় মুক্তি পাবে সিনেমাটি। বর্তমানে বিদেশে মুক্তির চুক্তির প্রক্রিয়া চলমান।’
এদিকে ‘দিন : দ্য ডে’ ছবির প্রযোজক অভিনেতা অনন্ত জলিল জানান, দেশে ছবিটির আকাশছোঁয়া সাফল্যের পর এটি এখন বিশ্বের আশিটি দেশে একসঙ্গে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, দর্শক আগ্রহের কারণে অগ্রিম টিকিটি বিক্রি হয়ে যাওয়া, সিনেমা হল, স্ক্রিন ও শোয়ের সংখ্যা বাড়ানোর যে জোয়ার শুরু হয়েছে মানসম্মত ছবি নির্মাণ করে তা ধরে রাখতে পারলে দেশীয় চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরতে বাধ্য। উল্লেখ্য, গত বছর এমন সাফল্য দেখিয়েছে ‘রেহানা মরিয়ম নুর’, ‘পদ্মাপুরাণ’, ‘নোনাজলের কাব্য’ ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘ছিটমহল’ ‘কালবেলা’ ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ছবিগুলো।