সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিয়ের সাত বছরের মধ্যেই জহিরকে হারাই

আজ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ৫১তম অন্তর্ধান দিবস। স্বাধীনতা যুদ্ধে নিখোঁজ বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ১৯৭২ সালের এই দিনে নিখোঁজ হন তিনি। তাঁর অন্তর্ধান দিবসে তাঁরই সহধর্মিণী চলচ্চিত্রকার কোহিনূর আক্তার সুচন্দার স্মৃতিকথা তুলে ধরা হলো-

শোবিজ প্রতিবেদক

বিয়ের সাত বছরের মধ্যেই জহিরকে হারাই

১৯৬৬ সালে আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। পরিতাপের বিষয়, বিয়ের মাত্র সাত বছরের মধ্যে তাঁকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। এসেই জানতে পারেন তাঁর অগ্রজ কথাশিল্পী শহীদুল্লাহ কায়সার নিখোঁজ। ভাই শহীদুল্লাহকে ঢাকার প্রায় সব জায়গায় খুঁজে ব্যর্থ হন জহির। ৩০ জানুয়ারি মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওইদিন জহির রায়হানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি সে যাওয়াই হবে জহিরের শেষ যাত্রা। ওইদিন সন্ধ্যায় মিরপুর থানায় ফোন করলাম। ফোন রিসিভ করলেন মেজর মঈন। তাঁকে জহিরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মেজর মতিউরকে ফোন ধরিয়ে দিলেন। তিনি কিছু জানাতে পারলেন না। এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। ক্যান্টনমেন্ট গেলাম। মেজর মঈন ও মতিউরের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁরা বললেন, ওইদিন মিরপুরে অপারেশন হয়েছে। কোথায় গেছেন, কী হয়েছে তাঁর, কিছুই জানেন না তাঁরা। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলাম। কয়েক দিন পর মিরপুর থানায় গেলাম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য পুলিশের সাহায্য চাইলাম। পুলিশ দুজন অবাঙালিকে ধরে আনল। তাদের বর্ণনায় সেদিন বিহারিদের সঙ্গে প্রচন্ড গোলাগুলি হয়েছিল সেখানে। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ তাদেরসহ আমাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। আশপাশের কয়েকটি কলাগাছের নিচে মাটি খোঁড়া হলো। বেরিয়ে এলো অসংখ্য মৃতদেহ। মৃতদেহগুলোর গায়ে কাপড় নেই। পচে বীভৎস হয়ে গেছে। চেনারও উপায় নেই। এরপর পুলিশ একটি কুয়ার কাছে নিয়ে গেল। মৃতদেহে ভর্তি ছিল কুয়াটি। আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। কোথাও জহির রায়হানকে খুঁজে পেলাম না। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেল। নিশ্চিত হলাম জহির রায়হানকে হারিয়ে ফেলেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি সান্ত্বনা দিলেন। আমার থাকার কোনো জায়গা ছিল না। পরে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে বনানীতে একটা বাসা পাই। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকার বাসাটি নিয়ে নেয়। সন্তানদের নিয়ে আবার রাস্তায় নামতে হয়। জহির রায়হান তো আমার জন্য কিছু রেখে যাওয়ার সময় পাননি। অনেক কষ্টে দিন যাপন করেছি। কেউ আমাদের কখনো খোঁজ নেয়নি। আমি নিজেও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। জীবনের সব হারিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেয়েছি।

জানি জহির রায়হানকে আর কোনো দিন খুঁজে পাব না। তাঁর বিনিময়ে এই স্বাধীন-সার্বভৌম  দেশই আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা।

সর্বশেষ খবর