শিল্পী আমি তোমাদেরই গান শোনাব, তোমাদের মন ভরাব- হ্যাঁ আমি শিল্পী হতে চেয়েছিলাম। ছোটবেলায় এই ইচ্ছাটা আমার কচি মনে কেমন যেন ছায়া ফেলে। মা আমার ইচ্ছা পূরণে এগিয়ে আসেন। প্রথমে নাচ শিখি। তখনো গানের পোঁকা মাথায় ঢোকেনি। চার বছর বয়সে নাচ শেখা শুরু করি। কত্থক, কত্থককলি, ভরত নাট্যম প্রভৃতি। তারপর বলতে পারেন নিজের অজান্তেই গানের জগতে চলে আসা।
উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা তার সংগীত জীবনের ৫০ বছরের ঘরে পৌঁছেছেন। অবারিত পূর্ণতার আলোতে দাঁড়িয়ে এভাবেই নিজের শিল্পী জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে আনমনে হারিয়ে গেলেন ফেলে আসা দিনগুলোতে। স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে বলে যান অনেক না-বলা কথা।
মা গাইতেন। বড় বোন দিনা লায়লা গান শিখতেন। আমার তখন ৩/৪ বছর বয়স। মা বলতেন আমি খেলতে খেলতে এসে বড় বোন যা গাইতেন তা নিজের কণ্ঠে তুলে নিতাম আর ওস্তাদজিকে গেয়ে শোনাতাম।
ছয় বছর বয়সে প্রথম স্টেজে গান করি। বলতে পারেন হঠাৎ করে। স্টেজে বড় বোনের গান করার কথা। তার গলায় সমস্যা দেখা দিল। আয়োজকরা পড়লেন মহাবিপদে। তারা আমার আব্বাকে বললেন, ওর নাম ঘোষণা করা হয়ে গেছে, এখন কী করব? আব্বা-আম্মা বললেন, ওর গলার যে অবস্থা ও তো গাইতে পারবে না, এক কাজ কর, আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে যাও। ওরা বলল, এতটুকু মেয়ে কী গাইবে! ওরা বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিল না আমি গাইতে পারি। আব্বা-আম্মা বললেন, ট্রাই করে দেখ, ভালোই পারবে ও। ব্যস, এটিই আমার স্টেজে প্রথম গাওয়া।
নয় বছর বয়স, করাচিতে থাকতাম। সেখানে আন্তঃস্কুল গানের প্রতিযোগিতা হয়। স্কুলের পক্ষ থেকে গেয়ে প্রথম পুরস্কার পাই। বড় অ্যারেঞ্জমেন্টের দিক থেকে এটি আমার প্রথম বড় মাপের পুরস্কার লাভ।
১৯৬৫ সালে তখন আমার বয়স ১২ বছর। লাহোর থেকে একজন মিউজিক ডিরেক্টর ও প্রডিউসার এলেন। তারা বড় পর্দায় ১০/১২ বছরের একটি বাচ্চা ছেলের কণ্ঠের গান চিত্রায়ণ করবেন। তখন রেডিও পাকিস্তানে আন্তঃস্কুল গান প্রতিযোগিতা প্রচার হয়। রেডিও থেকে তাদের জানানো হয় বছর তিনেক আগে একটি মেয়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। ওকে নিয়ে ট্রাই করে দেখতে পারেন। তারা আব্বার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আব্বা বললেন অসম্ভব। আমার মেয়েকে ফিল্মে গাইতে দেব না। পরে আব্বাকে ম্যানেজ করেন আম্মা। ছবির নাম 'জগনু'। গানের কথা 'গুরিয়সি মুনি্ন মেরি ভাইয়াকি পেয়ারি'। আমাদের শর্মিলী ভাবি ছিলেন হিরোইন। ছবিতে প্রথমে তার ছেলে পরে তার জন্য গাই। হিরোইনের কণ্ঠে স্যাড সং ছিল। ১২ বছর বয়সে স্যাড সং গাওয়ার ফিলিংস কীভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করি তা জানি না। আসলে সবই সৃষ্টিকর্তার দান। মনে আছে গানটি যখন গাই, মাইক্রোফোনের সামনে গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলেছিলাম। এমনভাবে কাঁদছিলাম যে, সেই কান্না আর থামেই না। পরে ওরা চকলেট দিয়ে আমার কান্না থামালেন।
১৯৭৪ সালে ঢাকায় আসি। আসলে আমরা করাচিতেই থাকতাম। আব্বা সেখানে সরকারি চাকরি করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আব্বাকে অপশন দেওয়া হলো পাকিস্তানে থাকবেন নাকি বাংলাদেশে চলে যাবেন। তখন আমরা এক বাক্যে বললাম, বাংলাদেশে চলে যাব, এখানে আর থাকব না।
১৯৭৪ সালে দেশে আসার পর সত্য সাহা দাদার সুরে প্রথম প্লে-ব্যাক ঢাকায়। ছবির নাম 'জীবন সাথী'। খন্দকার ফারুক আহমেদ সাহেবের সঙ্গে ডুয়েট গান। ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে গান করার জন্য প্রথম আমন্ত্রণ পাই। চিত্রপরিচালক নজরুল ইসলাম আর সংগীত পরিচালক সুবল দাস স্বরলিপি ছবির গান রেকর্ডিং করতে যান লাহোরে। তারা ছবির একটি গান আমাকে দিয়ে গাওয়ানোর পরিকল্পনা করেন। তখন আমি দারুণ ব্যস্ত। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছয়-সাতটি গান রেকর্ডিং করছি। সকাল ছয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গান রেকর্ডিং করতে হয়। লাহোরের বারী স্টুডিওতে রেকর্ডিং করা হয় গানটি। শিরোনাম 'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে'। একই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন মাহমুদুন্নবী। বাংলাদেশে আসার আগে আর কোনো বাংলা ছবিতে গান গাওয়া হয়নি।
মোট ১৮টি ভাষায় গাইতে পারি। বাংলা ছাড়া আমি উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানি। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছি। ভাষার এ পরিবর্তনটা কণ্ঠে তুলতে আমার দারুণ লাগে। প্রতিদিন ১০টি করে তিনদিনে ৩০টি গান রেকর্ড হওয়ায় গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে আমার নাম ওঠে। পাকিস্তানের আজমি সাহেব একজন নামকরা কম্পোজার। তার অনেক ছবির গান করেছি। গানগুলো শোনার পর মুম্বাইয়ের একটি রেকর্ড কোম্পানি প্রস্তাব করল, গানগুলো তারাও রেকর্ড করতে চায়। তাই ১০টি করে তিনদিনে ৩০টি গান রেকর্ড হয়েছিল। ঘটনাটি গিনেস বুকে ওঠে। এতে অনেকে আনন্দিত। কিন্তু আমি বিষয়টিকে দেখি ব্যস্ততার কঠিন উদাহরণ হিসেবে। ১০টি করে গান প্রতিদিন- ওরে বাবা, কী যে চোট গিয়েছিল!
১৯৮৩ সালে প্রকাশ হয় আমার প্রথম অ্যালবাম 'সুপার রুনা'। একদিনে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। এটা গোল্ড রেকর্ড। আর এ জন্য এইচএমভি থেকে গোল্ড ডিস্ক পেয়েছিলাম। ঘটনাটি এখনো খুব মনে পড়ে।
আমি খুব ভাগ্যবান। কারণ আমি উপমহাদেশের অনেক প্রখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে গান করার সুযোগ পেয়েছি। মোহম্মদ রফি সাহেবের সঙ্গে মুম্বাইতে একটি গান করতে গিয়েছিলাম। সুরকার ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি। আমি যখন স্টুডিওতে ঢুকি তখন দেখি অলরেডি রফি সাহেব বসা। তাকে দেখে ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম এটা কি হলো! এতবড় একজন শিল্পী?বসে আছেন আর আমি পরে এসেছি। ব্যাপারটা বেয়দবি হয়ে গেল। যা হোক আমি ঢুকে ওনাকে সালাম করলাম। বললাম, আমার জন্য এটা স্বপ্নের মতো যে, আপনার সঙ্গে গাইতে পারব, তা কখনো ভাবিনি। উনি হেসে বললেন, আসলে এটা আমার জন্য সম্মানের ব্যাপার। আমি আপনার মতো একজন শিল্পীর সঙ্গে গাইতে পারছি। তার কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে এলো। এত বড় মাপের মানুষ আমাকে এভাবে সম্মান দেখালেন! ভাবতে এখনো অবাক লাগে।
আরেকবার ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে আমি একটি অনুষ্ঠানে গাইছিলাম। উনি 'গঙ্গা আমার মা' গানটি গাইলেন। অনুরোধ আসছিল গানটি আরেকবার গাওয়ার জন্য। তখন উনি বললেন, গানটির যিনি মা, তিনিই গাইবেন। তাই এই গানটি আমার কাছে খুব স্পেশাল এবং?দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্বের মেলবন্ধন।
১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে কেনেডি সেন্টারে আমার প্রথম কনসার্ট ছিল। সেখানে আমি ছিলাম প্রথম কোনো এশিয়ান শিল্পী। ওখানে তখন ওরা বাংলাদেশি পতাকা উড়িয়েছে। জিমি কার্টার তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সপরিবারে এসেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে স্টেজে এসে তারা আমার গানের প্রশংসা করেন। খুব ভালো লেগেছিল ব্যাপারটি।
আমি গর্ববোধ করি যে, আমি বাংলাদেশি একজন শিল্পী। আমার যতটুকু ক্ষমতা, বাংলাদেশকে দেশের বাইরে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমি যেখানেই যাই, বলা হয় 'রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ' অথবা 'রুনা লায়লা অব বাংলাদেশ'। এ ব্যাপারটা আমার কাছে খুব গর্বের।
৫০টি বছর আমি গেয়েছি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পথটাকে খুব দীর্ঘ মনে হয়নি। মনে হলো, এই তো সেদিনের কথা। সময় কত দ্রুত বয়ে যায়। তবুও আগামীর পানে তাকিয়ে রই।