হানিফ সংকেত। আমাদের শোবিজ অঙ্গনের একজন সফল মানুষ। তার নির্মিত শিকড় সন্ধানী 'ইত্যাদি' অনুষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের আপনজন তিনি। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদে আসছেন জমকালো চমকানো 'ইত্যাদি' নিয়ে। কথা হলো তার 'ইত্যাদি' ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে-
ইত্যাদি ঈদ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ঈদের সময় ইত্যাদি হবে না, এটা কখনোই ভাবা যায় না। এর কারণ কি?
মানুষের ভালোবাসা। আর এ ভালোবাসা একদিনের নয়। দীর্ঘ সময়ের ধারাবাহিকতায় এ ভালোবাসা এসেছে। '৮৯ সালে 'ইত্যাদি' শুরুর পর থেকে যখন দেশে কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না, ভিসিআর ছিল না, তখনো টিভি গাইড জরিপ থেকে শুরু করে হালের নানা জরিপে 'ইত্যাদি'র অবস্থান শীর্ষে। এটা তো দর্শকদের ভালোবাসা।
এখন তো দেশে অনেক চ্যানেল, হাজারো অনুষ্ঠান। তারপরও 'ইত্যাদি' এত জনপ্রিয় কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর দর্শক এবং আপনারাই ভালো দিতে পারবেন। তবে 'ইত্যাদি' এক নম্বর কি দুই নম্বর এ নিয়ে মাথা ঘামাই না। অতিমাত্রায় বাগাড়ম্বরও করি না। আমাদের চিন্তা দর্শকহৃদয়ে কিভাবে স্থান পাওয়া যায়। দর্শকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে তাদের মন-মানসিকতা বুঝে সময়কে ধরে এগোতে চেষ্টা করি। সংখ্যার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দেই। সবচেয়ে বড় কথা দর্শক সময় বের করে আমাদের অনুষ্ঠানটি দেখতে বসেন। আমিও তাদের সেই সময়ের মূল্য দিতে চেষ্টা করি। এটুকু বলতে পারি ঈদের হাজারো অনুষ্ঠানের ভিড়ে 'ইত্যাদি' স্বতন্ত্র।
এবারের ঈদ ইত্যাদির বৈশিষ্ট্য কি?
ঈদ হচ্ছে আনন্দের। আর 'ইত্যাদি' সবসময়ই সমকালীন বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান করে। তাই ঈদের অনুষ্ঠানটিতে আমরা চেষ্টা করি মানুষকে নির্মল বিনোদন দিতে। যে বিনোদনের উল্টো পিঠ সরল অথচ নির্মল, সরস অথচ তীক্ষ্ন, সহজ অথচ তির্যক। তবে সবকিছুর মধ্যেই 'ইত্যাদি'র স্বভাবজাত বক্তব্য থাকবে। যা বিনোদনের মাধ্যমেই তুলে ধরা হবে।
'ইত্যাদি'তে এবার দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের বেশ কটি গান রয়েছে। গানগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
'ইত্যাদি'র গান কিন্তু আমি-তুমি, তুমি-আমি কিংবা শুধু প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কখনই হয় না। 'ইত্যাদি'তে যে কটি গান দেখবেন প্রত্যেকটি গানেরই কথা, সুর ও পরিবেশনায় যেমন ভিন্নতা থাকবে তেমনি গানের পাত্রপাত্রী নির্বাচনেও ভিন্নতা থাকবে। যেমন সাবিনা ইয়াসমিন ও তার কন্যা বাঁধন একটি গান গেয়েছেন কিন্তু সঙ্গে নৃত্যে ছিলেন মৌ ও তার কন্যা পুষ্পিতা। এই শিল্পীদের এভাবে এর আগে কখনো টিভি পর্দায় দেখা যায়নি। এ্যান্ড্রু কিশোরের গানটির মাধ্যমে আমরা প্রবাস জীবনের দুঃখ বেদনার কথা বলতে চেয়েছি।
তেমনি দলীয় সংগীত এবং সাত ভাই চম্পা গানটির মাধ্যমেও আমরা বিনোদনের পাশাপাশি একটি বক্তব্য উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া 'ইত্যাদি'তে কখনোই কোনো শিল্পীর পুরনো গান প্রচার করা হয় না।
আপনি তো সবসময় সব বয়সের সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন। কেন?
অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। টেলিভিশন কি কোনো নির্দিষ্ট পেশার মানুষদের জন্য? টেলিভিশন তো সবার-সব শ্রেণি পেশার মানুষের। তাই 'ইত্যাদি'তে উঠে আসে সবার কথা। 'ইত্যাদি'কে বলা হয় সব বয়সের, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ইত্যাদি। আপনারাই বলেন শেকড় সন্ধানী 'ইত্যাদি'। এর কারণ দুই দশক আগে যখন কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেলই ছিল না তখন থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে আমাদের প্রাচীন নিদর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গিয়ে 'ইত্যাদি' নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছি। তুলে ধরেছি সেইসব স্থানের নানান তথ্য। আমরা আনন্দিত আমাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই বিভিন্ন স্থানে গিয়ে এখন অনুষ্ঠান করছেন। তবে হ্যাঁ-যদি পেশা নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করতেই হয় তবে সব মেহনতী মানুষের বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক-জেলে-তাঁতি-কামার-কুমোর সবাইকে নিয়ে অনুষ্ঠান করব-কারণ দেশ গড়ায় কারও অবদানই কম নয়।
'ইত্যাদি'র একটি বড় আকর্ষণ বিদেশিদের পর্ব। বিদেশিদের নিয়ে এত বড় আয়োজনে অনুষ্ঠান করার ধারণাটা মাথায় এলো কী করে? আর এত বিদেশিইবা জোগাড় করেন কী করে?
এটি আমারও একটি প্রিয় পর্ব, কারণ এর মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। আমাদের এখানে অনেকেই যখন মিডিয়াতে 'বাংলিশ' উচ্চারণে পরাশ্রয়ী সংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে সেসময় আমরা বিদেশিদের দিয়ে বাংলা ভাষায় একদম গ্রামের সহজ সরল মানুষের চরিত্রে অভিনয় করিয়ে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি আমাদের লোকজ সংস্কৃতি। গ্রামের ঐতিহ্যবাহী নানান খেলাধুলা-লাঠিখেলা, হা-ডু-ডু, ফুটবল, ডাংগুলি, বাঁশের সাঁকো হাতল ছাড়া পার হওয়া, নদীতে সাঁতার কাটা, দ্রুত গাছে উঠা, দ্রুত কাঁথা সেলাই করা, মুড়ি ভাজা, মরিচ বাটা ইত্যাদি। গ্রামের মানুষ এসব সহজেই করতে পারে। তাই তাদের দিয়ে টেলিভশনে এসব খেলা দেখানোর চাইতে যারা এইসব খেলার সঙ্গে পরিচিত নয়-জীবনে কখনো দেখেনওনি-তারা যখন এসব খেলাধুলা করেন তখন দর্শকরা বেশি আনন্দ পান। আর এটাই হচ্ছে বৈচিত্র্য। গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতিসহ সব মানুষ একাত্দ হয়ে যান তাদের সঙ্গে। এসব অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় এবারেও এই পর্বে গ্রামের কৃষকদের একটি সমস্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আর বিদেশিদের জোগাড় করার ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি রয়েছে। সেটা নাইবা বললাম।
'ইত্যাদি'র প্রাপ্তি কী?
প্রধান প্রাপ্তি মানুষের ভালোবাসা। কিছু অসহায় মানুষ ও তাদের পরিবারের মুখের হাসি। যখন দেখি ইত্যাদিতে দেখানো প্রচার বিমুখ মানুষগুলো রাষ্ট্রীয় সম্মান পান, ভালো লাগে। ইত্যাদির প্রতিবেদন দেখে কেউ যখন অনুপ্রাণিত হয় তখন আমরা আনন্দ পাই। সবাই যখন ভেজালবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হন ভালো লাগে। কারণ কাজটি আমরাই শুরু করেছিলাম। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে 'ইত্যাদি' মানুষকে নির্মল আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি এর বিভিন্ন প্রতিবেদন মানুষকে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে। নানারকম জীবনের গল্প মনুষ্যত্বের বোধকে দাঁড় করিয়েছে বিবেকের কাঠগড়ায়। অনেকেই জীবনে কিছু করতে না পারার অভিমান ও কষ্ট ভুলেছেন এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সঙ্গে উপভোগ করেছেন বহু আরাধ্য স্বপ্ন ছোঁয়ার আনন্দ। তাদের কাজ দেখে মমতায় আর্দ্র হয়েছে কোটি দর্শকের চোখ। তখন আবেগে আপ্লুত হয়েছি। এদের কারোরই পুরস্কার পেয়ে দায়িত্ব বাড়েনি। বরং তারা দায়িত্ববান হওয়াতেই পুরস্কৃত হয়েছেন।
আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থান সম্পর্কে জানার এবং জানাবার আগ্রহ নিয়ে 'ইত্যাদি'-কে নিয়ে যান বহিরাঙ্গনে, দেশের বিভিন্নস্থানে কিন্তু ঈদের ইত্যাদির মঞ্চ ধারণের জন্য ইনডোর স্টেডিয়ামকে নির্বাচন করলেন কেন?
বর্ষা মৌসুমে হয় বলে আমরা কখনোই ঈদের অনুষ্ঠানটি ঢাকার বাইরে করতে পারিনি। ঈদের অনুষ্ঠান বৃষ্টির মধ্যে হলে অনেকগুলো সমস্যা হয়। প্রথমত, অনুষ্ঠানটি হয় রাতে। তাই প্রচুর লাইট ব্যবহার করতে হয়। বৃষ্টিতে লাইট জ্বালানো যায় না। আবার উন্মুক্ত স্থানে বিশাল সেট নির্মাণ করতে হয় বলে বৃষ্টিতে ভিজলে সেটও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ঈদ 'ইত্যাদি'-তে থাকে ব্যাপক আয়োজন। কখনো ৫০০ থেকে সহস্র শিল্পীর অংশগ্রহণ থাকে। বৃষ্টির কারণে যদি একদিন অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায় তখন ব্যস্ত শিল্পীরা শিডিউল সংকটে পড়েন। এসব কারণেও বর্ষা মৌসুমে ঈদের অনুষ্ঠান ঢাকার বাইরে করতে পারি না। তবে শীতকালে যখন ইত্যাদি হবে তখন অবশ্যই ঢাকার বাইরেই ঈদ ইত্যাদি হবে।
আপনার নাটক ও ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য কতটুকু?
তেমন কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। 'ইত্যাদি'র মতো বিনোদনের পাশাপাশি নাটকেরও গল্পের মাধ্যমেও আমি কিছু বলতে চেষ্টা করি। দর্শকরা যখন সেটা গ্রহণ করেন, তখন আমি আনন্দ পাই। আশা করছি এবারের নাটক সুসময়ে সকলেই...দর্শকদের ভালো লাগবে।
দর্শকদের জন্য কিছু বলুন-
মুখের কথায় নয়, কর্ম দিয়েই দেশকে গড়তে হয়।
ঈদের এই উৎসব মুখর দিনে,
নিজের শিকড় চিনে,
মহা-মিলনে বাঁধা পড়ি যেন
দেশের মাটির ঋণে।
আনন্দময় হয়ে উঠুক আপনাদের ঈদ উৎসব।
শোবিজ প্রতিবেদক