১৬ নভেম্বর, ২০২০ ১৬:০৯

এই ‘লোক দেখানো’ ক্ষমা কি আপনি চাইবেন?

আমিনুল ইসলাম

এই ‘লোক দেখানো’ ক্ষমা কি আপনি চাইবেন?

আমিনুল ইসলাম

আমি রাজনীতিবিদ নই। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্তও নই। 
নিজেকে লেখক বলতেও আমার সঙ্কোচ হয়। 
আমি সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র এবং শিক্ষক। সেই সাথে লেখালেখি'র চেষ্টা করি। সমাজের নানান অসঙ্গতি তুলে ধরার চেষ্টা করি। 
আমার এই লেখা এই দেশের একটা পক্ষের পছন্দ নাও হতে পারে। 
লেখার আগে আমি বেশ কয়েকবার ভেবেছি- এই নিয়ে লেখা উচিত হবে কিনা। এরপর মনে হয়েছে সমাজের প্রতি দায় থেকে হলেও আমার লেখা উচিত। 
যেই দেশে মন্ত্রী-এমপিরা দিনে দুপুরে এমনকি স্কুল শিক্ষক'কে কানে ধরে উঠবস করায়! 
যে দেশে এমপি পুত্র প্রকাশ্য দিবালোকে মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ মেরে বুক উঁচু করে বলে- জানো আমি কার ছেলে? 
যেই দেশে রাজনৈতিক নেতারা ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। 
সেই দেশে একজন মন্ত্রী এবং সাংসদ প্রকাশ্য দিবালোকে গতকাল এক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা'র পায়ে ধরে মাফ চেয়েছেন।

আমি রাজনীতি করি না। আমার এই লেখা দয়া করে আপনারা যারা নানান দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত; সেই দৃষ্টি'তে দেখবেন না।

আমি জানি না এই এই মন্ত্রী'র উদ্দেশ্য কি ছিল। সেটা কারো পক্ষে'ই হয়ত জানা সম্ভব না। 
তবে ঘটনাটা পত্রিকায় পড়ে এবং ভিডিও দেখে বুঝার চেষ্টা করেছি।

ওই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা অনুষ্ঠানে বসার জন্য চেয়ার পান'নি। এই জন্য তিনি ক্ষোভ জানিয়ে চলে যাচ্ছিলেন অনুষ্ঠান থেকে। এতে অনুষ্ঠানের অতিথি ওই মন্ত্রী'র হয়ত খুব একটা দায় ছিল না।

অনেকেই ওই মুক্তিযোদ্ধাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন ফায়দা হয়নি। তিনি চলেই যাচ্ছিলেন।

এমন সময় ওই মন্ত্রী দৌড়ে এসে প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার পায়ে চেপে ধরে ক্ষমা চান। এরপর অবশ্য ওই মুক্তিযোদ্ধা রাজি হয়েছেন।

তো, এই হচ্ছে ঘটনা। এরপর এখন কি হচ্ছে জানেন?

বিরোধীদলের (সেটা যখন যে দল'ই থাকুক) মানুষ তো এই দেশে সরকার যে কোন কাজ করলেই সেটার সমালোচনা করে। ঠিক যেমনটা সরকার করে বেড়ায় বিরোধীদলের সম্পর্কে। আমরা যারা রাজনীতি করি না; তারা এই সবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। 
এখন দেখছি এমনকি মন্ত্রী'র নিজ দলের মানুষরাও এই নিয়ে হাসাহাসি করছে। সমালোচনা করছে!

কেউ বলছে- ছিঃ ছিঃ কতো বড় আঁতেল! পায়ে ধরে ক্ষমা চায়! নিশ্চয় বদের হাড্ডি! 
আরেকদল বলছে- এইভাবে কেউ ক্ষমা চায়!

অন্য আরেক দল বলছে, ক্ষমা চেয়েছেন ভালো কথা। নিজের ফেসবুকে এটা নিয়ে আবার লেখার কি আছে।

এইসব দেখে এক রকম সামাজিক দায় থেকে লিখতে বসেছি।

হুমায়ূন স্যারের জন্মদিন ছিল ১৩ নভেম্বর। ইচ্ছে করে'ই এই জন্মদিনে কিছু লিখিনি। উনার সাথে সপ্তাহ খানেক কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এই জন্মদিনে আমি স্রেফ ওই সময়গুলো নিজের মতো করে মনে করার চেষ্টা করেছি।

যা হোক, হুমায়ূন আহমেদ তার কোথাও কেউ নেই বই'তে একটা চমৎকার বিষয় লিখে গিয়েছেন। আপনারা যারা নাটক'টি দেখেছেন, তাদের মনে থাকার কথা।

বাকের ভাই'কে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। কেউ তাকে ছাড়াতে যাচ্ছে না। এলাকার মেয়ে মুনা এরপর বাকের ভাই'র বড় ভাইয়ের কাছে গিয়েছে। যে কিনা বড় সরকারি কর্তা। গিয়ে বলেছে:

- আপনি আপনার ভাই'কে ছাড়িয়ে আনতে যাচ্ছেন না কেন? 

-সে একটা বখাটে। তাকে ছাড়িয়ে আনার কিছু নেই।
 
-কিন্তু তিনি তো মানুষের উপকারও করেন।

-এইসব লোক দেখানো উপকার।

এরপর মুনা বলেছে:

- সেই লোক দেখানো উপকারটাই বা কয় জন করছে? আপনি করবেন? কেউ একজনের লোক দেখানো উপকারে যদি কারো জীবন বেঁচে যায়, তাহলে ক্ষতি কি?

হুমায়ূন স্যারের লেখা এই উক্তিটা আমি মাঝে মাঝে'ই ব্যবহার করি। মানুষ যখন বলে- লোক দেখানো উপকার; তখন আমার খুব হাসি পায়। সেই উপকারটাই বা কয় জন করছে? সমাজে বিনা স্বার্থে উপকার করার মানুষ কি খুব একটা আছে? কেউ যদি লোক দেখানো উপকার করে কারো জীবন বাঁচিয়ে দেয় কিংবা কারো ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায় তো ক্ষতি কি?

একজন বর্তমান মন্ত্রী প্রকাশ্যে পা ধরে একজনের কাছে ক্ষমা চাইছেন; সেটা তো আমাদের সবার'ই উচিত প্রশংসা করা।

যেই দেশে মন্ত্রী-এমপিরা মানুষকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মানুষ মেরেও বলে- জানো আমি কার সন্তান! কেউ কোন দিন কোন অন্যায় স্বীকার'ই করে না। 
সেই দেশে একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে পা ধরে একজন প্রবীণ ব্যক্তি'র কাছে ক্ষমা চাইছে; এতেও আমরা সমালোচনা করে বেড়াচ্ছি। হাসাহাসি করছি। কেউ কেউ আবার বলছে এইসব লোক দেখানো!

তো, এই লোক দেখানো ক্ষমা কি আপনি চাইবেন? নাকি চেয়েছেন কোন দিন?

ক্ষমতা যে কতোটা খারাপ, সেটা নিশ্চয় কারো অজানা নয়। আমি নিজ জীবন থেকে সেই শিক্ষা পেয়েছি। একজনকে সামান্য একটু ক্ষমতা দিয়ে দেখেন আপনার জীবনে। সে আর আপনাকে মানুষ'ই মনে করবেন না। ক্ষমতা মানুষকে অমানুষ করে দেয়।

যেই দেশে অপরাধ করে কেউ অপরাধ স্বীকার'ই করে না। সেই দেশে একজন মন্ত্রী ক্ষমা চাইবার পরও মানুষ এই নিয়ে হাসাহাসি করছে।

তাহলে মানুষজন ভুল স্বীকার করবে কেন? ক্ষমা চাইবে কেন?

আবার এই আমরা'ই বলি- ক্ষমা চান। ভুল স্বীকার করেন!

আমাদের তো সভ্যতার এই সংস্কৃতি'ই গড়ে উঠেনি।

এই মন্ত্রী যদি লোক দেখানোর জন্যও পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে থাকে; তাতে সমস্যা কোথায়? 
সেই ক্ষমাটাই বা কয়জন চাইছে?

আমাদের সবার'ই  উচিত প্রশংসা করা। তার অন্য অনেক কাজের যদি সমালোচনা করতে হয়, করুন। কিন্তু এই কাজের সমালোচনা করতে হবে কেন? এটি'র প্রশংসা করুন।  যাতে করে এমন সংস্কৃতি সমাজে গড়ে উঠে। মানুষজন যাতে তাদের ভুল বুঝতে পারে। ক্ষমা চাইতে যেন শেখে।

অপছন্দের মানুষ কিংবা বিপরীত পক্ষের কেউ যে ভালো কিছু করতে পারে; এর জন্য যে প্রশংসা করা সম্ভব; সেই ব্যাপারটাই আমরা জানি না। এটা চর্চার ব্যাপার। এই সংস্কৃতি আমাদের গড়ে তুলতে হবে। নইলে জীবনেও আমরা সভ্য হবো না।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর