৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৫:২৯

‘কত মানুষই তো বেঁচে আছে আমার দেশে অনাহারে, অর্ধাহারে!’

রিমি রুম্মান



‘কত মানুষই তো বেঁচে আছে আমার দেশে অনাহারে, অর্ধাহারে!’

রিমি রুম্মান

ডিসেম্বরের প্রথম দিন সেদিন। জরুরি কাজে বের হয়েছি। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে পার্কিং গ্যারেজে অপেক্ষা করছি গাড়ি গরম হবার জন্যে। সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করতেই দেখি বাড়ির পাশের বিশাল স্কুল বিল্ডিং। সেখানে মাস্ক পরিহিত কিছু মানুষের লাইন। দিনের এই সময়টাতে বাইরে বের হওযার সময় প্রায়ই মানুষের লম্বা লাইন দেখা যায়। কেউ কেউ রাস্তার কিনার ঘেঁসে গাড়ি পার্ক করেই দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। তাড়াহুড়ায় কিংবা ব্যস্ততায় কখনো কৌতূহল জাগেনি কেনো, কিসের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে এত মানুষ!

সেদিন খানিকটা কৌতূহল জাগে। লাইন দ্রুতই ছোট হচ্ছে। আবার অনেকেই যোগ দিচ্ছে নতুন করে। আমি বাইরে কাজ সেরে ফিরে এসে যখন গাড়ি পার্ক করছিলাম, তখনো ৩/৪ জন লাইনে দাঁড়িয়ে। তারা এগিয়ে যাচ্ছেন একে একে। ব্যাগ ভরে কিছু নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। কৌতূহলী মনে আমিও গিয়ে শেষ ব্যক্তিটি হিসেবে দাঁড়াই সেখানে। সামনে এগোতেই দেখি টেবিল ভর্তি খাবারের প্যাকেট নিয়ে তদারকিতে ব্যস্ত দুজন কর্মী। আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, 'কয়জন'? আমি এর অর্থ বুঝতে দেরি হওয়ায় উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারও প্রশ্ন করলেন, তোমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত? বললাম, পাঁচজন। অমনি দুটি ব্যাগে খাবার ভরে হাতে ধরিয়ে দেয়।

বাড়ির দিকে পা বাড়াই যখন, তখন সূর্য ডোবার পরের প্রহর। বাড়িতে এনে খুলে দেখি ব্যাগ ভর্তি লো ফ্যাট মিল্ক, চকলেট মিল্ক, বেবি ক্যারট, বিস্কিট, আপেল, অরেঞ্জ, ভেজিটেবলস ফ্রাইড রাইস, চিকেন নাগেট, ব্রেডসহ আরও অনেক পুষ্টিকর খাবার! প্রতিদিন মানুষকে বিনামূল্যে, বিনা প্রশ্নে এত খাবার দিচ্ছে! যথারীতি ছেলেরা ছুটে আসে। খাবার দেখে ছোট ছেলের চক্ষু ছানাবড়া! চোখ গোলাকৃতি করে বলে উঠে, 'এইসব খাবার তুমি কোথায় পেলে? এসব তো আমরা স্কুলে খাই'! বড় জন বলল, 'মা, খাবারগুলো আনা ঠিক হয়নি। আমাদের তো কিনে খাবার সামর্থ্য আছে। যাদের চাকুরি নাই, খাবার কেনার সামর্থ্য নাই, এসব তাদের অনেক কাজে লাগত।' আমার আর বলা হয়নি যে, কৌতূহলবশত সেখানে গিয়েছিলাম।

আমি বারান্দার কাঁচ ঠেলে বাইরে গিয়ে দাঁড়াই। ল্যাম্পপোস্টের ম্যাড়ম্যাড়ে আলো। হিমেল বাতাস। পশ্চিমাকাশে মেঘের নড়াচড়া। ভেতরটা নিংড়ে জল এসে গেল। আমি তো এমনটিই চেয়েছি চিরকাল। আমার সন্তানরা মানবিক মনের মানুষ হোক। তারা মানুষকে ভালোবাসুক। সমাজের অনগ্রসর মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হোক। কিন্তু সব অনুভূতি পেছনে ঠেলে আমার ভাবনা অন্যখানে। প্রাচীন দালানের স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আঁকড়ে বেঁচে থাকা গাছের মতো কত মানুষই তো বেঁচে আছে আমার দেশে অনাহারে, অর্ধাহারে! আমি আধো অন্ধকারে বসে থাকি। অন্ধকারে বেশিক্ষণ বসে থাকলে সে-ও তো একসময় চোখে সয়ে যায়! 

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর