বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

গুলশানের বাড়ি নিয়ে হতাশায় আত্মহত্যা!

গুলশানের বাড়ি নিয়ে হতাশায় আত্মহত্যা!

‘অনেক দিন ধরেই বাবা হতাশায় ভুগছিলেন। বাবা ঘন ঘন আমাদের চার ফুফুর বাসায় যাইতেন। ফুফু ও দাদিরে প্রায়ই কইতেন আমার পোলা-মাইয়াগো দেইখ্যা রাইখো। তবে বাবা যে এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবেন তা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। তবে আমার মনে হয় বাবার আত্মহত্যায় বাধা দিচ্ছিলেন মা। এতে উত্তেজিত হয়ে আগে মা-কে খুন করে বাবা নিজে আত্মহত্যা করেন।’ কথাগুলো বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন বনানীর পুরাতন ডিওএইচএস-এ নিহত শিল্পপতি আবদুর রব ও রুসখানা পারভীন দম্পতির ছোট ছেলে নাজিব আহমেদ।
এ ঘটনায় নিহত দম্পতির পরিবারের পক্ষ থেকে সোমবার রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। নিহত দম্পতির মেজো ছেলে নাঈম আহমেদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় পারিবারিক কলহকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দুটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাদ আসর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এর আগে লাশ উদ্ধার করার সময় পুলিশের তৈরি করা সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বেডরুমে খাটের ওপর রোকসানার লাশ উপুড় হয়ে পড়েছিল। ঘরের দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসানো অবস্থায় ছিল আবদুর রবের লাশ। রোকসানার বুকের ডান পাশে গোলাকার ও পিঠের ডান পাশে গভীর ছিদ্র রয়েছে। আবদুর রবের ডান কানের নিচে গোলাকার ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্র মাথার বাম পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। এগুলো গুলির চিহ্ন বলে সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পিস্তলের গুলির দুটি খোসা উদ্ধার হয়। এ ছাড়া মেঝেতে পড়েছিল আবদুর রবের ব্যবহৃত লাইসেন্সকৃত পিস্তল।
নিহত দম্পতির পারিবারিক সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়িক লোকসানের কারণে হতাশায় ভুগছিলেন আবদুর রব। একই সঙ্গে চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছিল ব্যাংক লোন। ৯০ সালে জনতা ব্যাংক থেকে নেওয়া ২০ কোটি টাকার লোন সুদসহ বেড়ে দুই বছর আগে ৩৩ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। গত দুই বছর আগে ব্যাংক লোনের কিছু অংশ পরিশোধের পর বর্তমানে তা ২৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
নিহতের মেজো ছেলে নাঈম আহমেদ বলেন, ‘আবুল খায়ের গ্রুপের কাছে আমার বাবা নারায়ণগঞ্জ আলীগঞ্জ মুন্সীখোলা ১০৫ বিঘা জমি বিক্রির জন্য হাত বায়না করেছিলেন। তবে আবুল খায়ের গ্রুপ এখন দাবি করছে ওই হাত বায়নায় আমাদের গুলশান-২ এর ১৭ কাঠার বাড়িটিও ছিল। এ নিয়ে আমার বাবা দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন।’
নিহতের বাল্যবন্ধু ইকবাল হোসেন বলেন, রব গুলশানের বাড়িটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় ভুগছিল। ভাবী (রবের স্ত্রী) প্রায়ই বলত, গুলশানের বাড়িটি না থাকলে আমাদের সন্তানরা কোথায় থাকবে? এ নিয়ে ভাবী ও রবের মধ্যে ঝগড়া হতো। তবে রব সব সময়ই বলত, ‘আমার সঙ্গে আবুল খায়ের গ্রুপ প্রতারণা করেছে। এ জন্য আমি বাড়িটি ডেভেলপারকেও দিতে পারছি না।’
মেজো ছেলে নাঈম আরও বলেন, দাদা আফছার আহমেদের নামে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নাম আফছার গ্রুপ। বাবারা ছিলেন দুই ভাই। এদের মধ্যে আলাউদ্দিন আহমেদ ১৯৯১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আফছার গ্রুপ পরিচালনার পাশাপাশি পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে তার বাবার ওপর। পারিবারিক ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফতুল্লার আফছার অয়েল মিল ও সোনালী টোব্যাকো লিমিটেড ২০০১ সালে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেন বাবা। ১৯৯০ সালে আফছার গ্রুপ জনতা ব্যাংক থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে সুদেআসলে প্রায় ৩৩ কোটি টাকায় পৌঁছে। পরে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের জন্য নারায়ণগঞ্জের পাগলার মুন্সীখোলার ১০৫ বিঘা জমি তার বাবা আবুল খায়ের গ্রুপের কাছে ১২ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। এই জমি বিক্রির সময় তার বাবা আবুল খায়ের গ্রুপের কাছে গুলশানের ৯৫ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর দোতলা বাড়িটি ১৭ কাঠা জমিসহ বিক্রি করার বায়না করেন। কিন্তু এই জমিতে তার চার ফুফু ওয়ারিশ। এই বাড়িসহ এই জমি বিক্রি নিয়ে তার মায়ের সঙ্গে বাবার কয়েকদিন কলহ চলছিল।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার লুৎফুল কবির জানান, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। সত্যিই কি আবদুর রব আগে স্ত্রীকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন নাকি ঘটনা অন্য কিছু তা জানতে ফরেনসিক রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হবে। এ জন্য আবদুর রবের ব্যবহৃত পিস্তলের ফিঙ্গার প্রিন্স যাচাই-বাছাই করা হবে। এই ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি।

সর্বশেষ খবর