বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

এক ব্যাংকে পরিচালক অন্য ব্যাংকে ঋণগ্রহীতা

পরস্পর যোগসাজশে অনিয়ম দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতা জালিয়াতি

এক ব্যাংকে পরিচালক অন্য ব্যাংকে ঋণগ্রহীতা

এক ব্যাংকের পরিচালক, অন্য ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা। এ যেন রক্ষকই ভক্ষক। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম-জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে তা দীর্ঘদিন পরিশোধ করছেন না খোদ পরিচালকরাই, এমন ঘটনাও ঘটছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের ব্যাংকে এমন জাল-জালিয়াতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সর্বশেষ ২০১৩ সালে ব্যাংকিং খাতে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকদের নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এর আগে ২০১২ সালে এ পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকরা অস্বাভাবিক হারে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এতে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, এর চেয়েও স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এর পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পরিচালকদের অনিয়ম আর দুর্নীতির আগ্রাসন ঠেকাতে না পারলে এ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পরিচালকদের নিজেদের স্বার্থে পর্ষদ সভায় বাইরের লোক নিয়ে এসে সিদ্ধান্ত নিতে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। পর্ষদ সভায় শুধু পরিচালকরা উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও যোগসাজশ করে ব্যাংকের শেয়ারধারী ব্যক্তিকে সভায় নিয়ে এসে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রভাব বিস্তার করা হয়। এমন ঘটনা বেশ কয়েকটি ব্যাংকেই পাওয়া গেছে। এ অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্তত চারটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকও নিয়োগ দিয়েছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের আরেকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। একই সঙ্গে আরেক ব্যাংকের এক পরিচালককে নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ দিতে চাইলে পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এ ঘটনায় চেয়ারম্যান ও কয়েকজন পরিচালকের মধ্যে ব্যাংক বৈঠকে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। চেয়ারম্যান বৈঠকের সিদ্ধান্ত পক্ষে নিতে নিজের ছেলে ও মেয়েকে পরিচালক করার জন্য পর্ষদকে অনৈতিকভাবে চাপ দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয়। এদিকে ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকেরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ বা আর্থিক সুবিধা নিতে না পারলেও তারাও বেনামে ঋণ নিচ্ছেন। এ ধরনের অভিযোগ প্রকাশিত হলে সম্প্রতি একটি ব্যাংকের এমডি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে পেল সে অপরাধে ব্যাংকটির এমডিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকিং খাতের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন পরিদর্শনে উঠে এসেছে, পরিচালকরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাসজশ করে নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ বাগিয়ে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তারা কৌশলে নিজেদের নামের পরিবর্তে স্ত্রী, পুত্র, ভাই বা কোনো আÍীয়স্বজনকে ঋণগ্রহীতা দেখিয়ে এর বৈধতা দিচ্ছেন, যা রীতিমতো ব্যাংক পরিচালক নীতিমালার বিরোধী। নিজেদের কোম্পানির নামে-বেনামে ঋণ মঞ্জুর করতে পরিচালনা পর্ষদকে পর্যন্ত প্রভাবিত করছেন অনেকেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্য গোপনের অভিযোগও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি আরও জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক পরিচালকদের ঋণের ব্যাপারে আগেও অনেক অভিযোগ আসত। এখন হয়তো তা আরও বেড়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়ানোর বিকল্প নেই। যেসব ব্যাংকের পর্ষদ বা পরিচালকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ  রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর ঘটবে না। ঘটনা-১ : পরিচালকদের অসততার কারণে সম্প্রতি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খোয়া গেছে, যেখানে অন্য একাধিক ব্যাংকের পরিচালকদের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে-বেনামে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতি মানা হয়নি বলে বলে জানা গেছে। ওই ব্যাংকের চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ ও লালদীঘি শাখায় জালিয়াতির ঘটনায় স্থানীয় একজন পরিচালকের যোগসূত্র রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। ওই দুই শাখায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। একই ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতিতেও পরিচালকদের হাত রয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা অন্য ব্যাংকের পরিচালকের বেনামি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। ঘটনা-২ : রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ছোট আকারের বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের খোদ চেয়ারম্যানের যোগাসাজশে ওই ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে বেআইনিভাবে। শুধু তা-ই নয়, গত পাঁচ থেকে সাত বছরে ওই ব্যাংক প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম হয়েছে। ওই ব্যাংকের সিএসআর ফান্ডের টাকা নিয়েও পরিচালকরা নানা ধরনের অনিয়ম করেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঘটনা-৩ : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন খোদ পরিচালকরা। এ পরিমাণ ঋণ তারা নিজেদেরে প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের নামে-বেনামে বিতরণ করেছেন। এতে বলা হয়, দুই পক্ষই নিজ নিজ ব্যাংকে অবৈধ সুবিধা দিচ্ছেন অন্য পরিচালকদের। তৃতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন ১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। প্রথম সারির একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালরা নিয়েছে ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। নানা অনিয়ম-দুর্নীতি জেঁকে বসায় ব্যাংকটিতে সম্প্রতি প্রশাসক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন অনিয়ম-দুর্নীতির জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে নতুন ব্যাংকগুলোও, যেগুলোর কার্যক্রম চালুর এখন তিন বছরও পূর্তি হয়নি। এমন একটি ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। আর অন্য এক ব্যাংকের পরিচালক চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক ওই নতুন ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক।
সূত্র জানায়, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বেআইনি প্রভাবে অধিকাংশ ব্যাংকই অর্থলোভী পরিচালকদের লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কয়েক কোটি টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হয়েছেন, এমন অনেকেই এখন শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নিজেদের ব্যাংক থেকে এরা নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছেন। পাশাপাশি তারা অন্য ব্যাংক থেকেও শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। অনেক পরিচালকই জড়িয়ে পড়ছেন বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতিতে। শুধু নিজ ব্যাংক থেকেই পরিচালকদের নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। বেনামে নেওয়া ঋণের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি। শুধু পরিচালকরা নন, জনগণের আমানতের টাকায় গড়ে ওঠা এসব ব্যাংক থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবও ক্ষমতার জোরে নিয়মবহির্ভূত ঋণ নিয়েছেন। আর এর সবই ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ তদারকির অভাবে, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর