মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ভারত নয় আরও অনেককে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ভারত নয় আরও অনেককে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ

১৯৭১ সালে যে দেশটি শূন্য থেকে শুরু করেছিল, চার দশক পর সেই বাংলাদেশই বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ভারতসহ অনেক নিম্নমধ্যম আয়ের দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (সিপিএফ)’ শীর্ষক এক কর্মশালায় এমন একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনের উপরে লেখা ছিল : ‘বিশ্বব্যাংক গ্রুপ কনসালটেশনস, অক্টোবর-নভেম্বর, ২০১৫’। কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়, বাংলাদেশ গঙ্গা-বহ্মপুত্র অববাহিকায় এক জনসংখ্যাবহুল ব-দ্বীপ। এই ব-দ্বীপ শুধু জীববৈচিত্র্যেই সমৃদ্ধ নয়, এখানকার মানুষের সংস্কৃতি জীবনযাত্রাও বৈচিত্র্যে ভরপুর। যদিও সমগ্র দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকির মুখে এবং বেশির ভাগ বাংলাদেশির বসবাস গ্রামীণ এলাকায়, তারপরও শিল্প ও সেবা খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কারণে সাম্প্রতিককালে নগরায়ণ ঘটছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত চার দশকে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে শূন্য থেকেও অনেক কিছু অর্জন করা যায়। দেশটির মানব সূচক উন্নয়নে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষার সুযোগ এবং নারী-পুরুষ বৈষম্য নিরসনের মতো বিষয়গুলোতে আশাব্যঞ্জক উন্নতি করেছে। স্বাধীনতার বছর, ১৯৭১ সালে অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পার্শ্ববর্তী ভারতের নিচে। কিন্তু আজ, ওইসব সামাজিক সূচকে শুধু ভারত নয়, অনেক স্বল্প এবং নিম্নমধ্যম আয়ের (লোয়ার মিডল ইনকাম) দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। এরপর বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ভারত ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর, ওই সময়ে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরে উন্নীত হয়েছে যেখানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর। একইভাবে ১৯৭১ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় আয়ু ৫২ বছর থেকে ২০১৩ সালে ৬৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারত এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় আয়ুর সীমা ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৪৯ জন। ওই সময় ভারতে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ১৪১ জন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ১২৪ জন। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে ৩৩ জনে নামিয়ে আনে। অথচ ভারতে এখনো প্রতি হাজারে ৪১ জন এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি হাজারে ৪৪ জন শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রেও ভারতসহ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর চেয়ে প্রভূত উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জন্মহার (প্রতি নারীর) ছিল ৬ দশমিক ৯ জন শিশু। যা ভারতে ৫ দশমিক ৪ এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৫ দশমিক ৬টি শিশু ছিল। বর্তমানে সেটি কমে বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২টি শিশু (প্রতি নারী), যা ভারতে এখনো ৪ দশমিক ৪ এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে ২ দশমিক ৯টি শিশু।

শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক সূচকে ভারত ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় ভালো করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের (২৫ বছর বা তার বেশি) স্কুলে শিক্ষা নেওয়ার গড় সময় ছিল ২ দশমিক ৪ বছর। বর্তমানে সেটি বেড়ে ৫ দশমিক ১ বছরে উন্নীত হয়েছে। আর ভারতে এখন প্রাপ্ত বয়স্কদের গড় শিক্ষা বছর ৪ দশমিক ৪ বছর যা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে ৫ দশমিক ৪ বছর রয়েছে। এক্ষেত্রেও ভারতকে ছাড়িয়ে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর কাতারে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ।

শিশুর টিকাদানে বাংলাদেশের অগ্রগতির হার উন্নত দেশগুলোকেও বিস্মিত করেছে। ১৯৭১ সালে প্রতি ১০০ জনে মাত্র ২ জন শিশুর টিকাদান নিশ্চিত হতো। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ শিশু টিকা নিচ্ছে। আর ভারতে শিশুদের টিকা নেওয়ার হার ৭২ এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৭৬ শতাংশ। উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে দেশের ৩৫ শতাংশ মানুষ উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় ছিল। বর্তমানে দেশের প্রায় ৫৭ শতাংশ মানুষ এই সুবিধা পাচ্ছে। আর ভারতের ক্ষেত্রে এই হার ৩৬ শতাংশ এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের ক্ষেত্রে ৪৭ শতাংশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় ৩৪ জন শিশু জন্মের পর অপুষ্টির শিকার হতো। এটি কমে বর্তমানে ১৬  জনে নেমে এসেছে। ভারতে এই হার এখনো ১৭ আর নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর অপুষ্টির গড় হার ১৫ শতাংশ। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও বাংলাদেশের অগ্রগতি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর সমমানে পৌঁছেছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বিশ্বব্যাংক বলছে, দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে ২০১৪ অর্থবছরে দেশটির মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৬ ডলারে পৌঁছেছে, যা বাংলাদেশকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। এ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় ২০১৫ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে এক হাজার ২২০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের এই অগ্রগতির ধারা এখানেই কী শেষ? নাকি আরও দূর যেতে হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

সংস্থাটি বলেছে, ২০২১ সালে যখন বাংলাদেশ তার উচ্চাকাক্সক্ষা অর্জন করে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাবে তখন উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, যা বর্তমান চ্যালেঞ্জের চেয়ে আরও বেশি কঠিন।

বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ প্রতিবেদনটি তাকেও দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি পেরুর লিমায় অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের উদ্বোধনী সেশনে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট ড. জিম ইয়ং কিম একটি মাত্র দেশের নাম উচ্চারণ করে বলেছেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক স্বল্প আয়ের দেশের কাছেই অনুসরণযোগ্য।

সর্বশেষ খবর