মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাবধান! মাঠে ৫শ আততায়ী

সাঈদুর রহমান রিমন

সাবধান! মাঠে ৫শ আততায়ী

ধর্মীয় উগ্রবাদে দীক্ষিত আর অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত পাঁচ শতাধিক দুর্ধর্ষ জঙ্গি সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারাই ধারাবাহিকভাবে খুন-খারাবিসহ নানা নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। হামলা-নাশকতার মাধ্যমে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছে এসব আততায়ী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জঙ্গিরা একের পর এক অপরাধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) দায়িত্বরত একজন (এসএস রাজনৈতিক) সিনিয়র পুলিশ সুপার জানান, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ এবং র‌্যাবের হাতে সারা দেশে ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ৬৭২ জন জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। বিচার শেষে এদের ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। বাকিরা দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রয়েছে। অনেকেই আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে সারা দেশে জঙ্গি নেটওয়ার্কে ১১টি নিষিদ্ধ সংগঠনে শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ১০ সহস্রাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সমর্থ এক হাজার জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। র‌্যাব শুরু থেকেই বিরামহীন অভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের ৭ শতাধিক দুর্ধর্ষ সদস্যকে গ্রেফতার ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মধ্যেই ৬ শতাধিক জঙ্গি সদস্য আদালতের জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে। আইনজীবীদের জিম্মায় জামিন নিয়েই দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা লাপাত্তা হয়ে গেছে।

২০১২ সালে জামিনে মুক্তির পর বর্তমান আমির গ্রুপের ফারুক হোসেন ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড শফিকুল ইসলাম শফিকের নেতৃত্বে ত্রিশালে পুলিশভ্যান থেকে সহযোগী জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফারুক-শফিক ছাড়াও মিলন, জাকারিয়া, সবুজ, সাজেদুর, মানিক, মাজিদসহ যে ১২/১৩ জন ত্রিশালের অপারেশনে অংশ নেয়, জানা গেছে তারা প্রায় সবাই জামিনে মুক্ত জঙ্গি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জঙ্গি সদস্য হিসেবে গ্রেফতার হলেও ‘শিক্ষার্থী’ পরিচয় দিয়ে জামিন নিয়েছে তারা। বিভিন্ন আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে জঙ্গি সদস্যরা কেউ আর স্থায়ী ঠিকানার বসতবাড়িতে গেল না। ফের গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় কারাগার থেকে বেরিয়ে সরাসরি সংগঠনের আস্তানায় ঠাঁই নিয়েছে। জঙ্গি টিমগুলো লোকালয়ের বাইরে দুর্গম পাহাড় বা বনাঞ্চলকে আস্তানা বানিয়ে প্রশিক্ষণ নিত। সে সব স্থানেই মাসের পর মাস কঠোর অনুশীলনসহ অস্ত্র চালনার নানা প্রশিক্ষণ শেষে রাজধানীসহ জনাকীর্ণ শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোতেই তারা নতুন করে ঠাঁই নিয়েছে। সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান না নিয়ে পাশাপাশি কয়েকটি বাসা-বাড়িতে আলাদা আলাদাভাবে ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে জঙ্গিরা। রাজধানী ঘিরে জঙ্গি ক্যাডারদের দুই শতাধিক ‘মেস ক্যাম্প’ গড়ে উঠেছে, এর মধ্যে ৪০টি মেস ক্যাম্প রীতিমতো দুর্গ স্টাইলের আস্তানায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সে সব ক্যাম্পে অবস্থান করছে কয়েকশ প্রশিক্ষিত সদস্য। যে কোনো মুহূর্তে রাজধানীজুড়ে একযোগে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পূর্ণ প্রস্তুতি তাদের আছে কি না সে সবও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার তৈরিকৃত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপনীয় শাখায় পাঠানো ওই প্রতিবেদনের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা চিহ্নিত মেসগুলোর ওপর নজরদারি শুরু করে। বিশেষ ওই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র শিবিরের দুই শতাধিক মেসে নিষিদ্ধ ঘোষিত তিন জঙ্গি সংগঠনের ক্যাডাররা প্রায় স্থায়ী অবস্থানই নিয়েছে। শিবির কর্মীরা বেশির ভাগ মেসেই রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রেখে একসঙ্গে বাস করে। সেখানে গোপনে তাদের মিটিংও চলে। এলাকা পর্যায়ে শিবিরের ক্যাডার নেতারা ‘জঙ্গিদের সঙ্গে সমন্বিত সম্পর্ক’ গড়ে তোলার মূল ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত জঙ্গি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্যরা এখন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের’ পতাকাতলে সংগঠিত হয়ে নানা লক্ষ্যভেদ পূরণ করে চলছে। নতুন করে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় তারা প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রথমত, ছদ্মবেশে জনমত গঠন, দ্বিতীয় পর্যায়ে টার্গেট করা ব্যক্তিদের হত্যা এবং সর্বশেষ জনবহুল এলাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানো। বিশেষ মিশন বাস্তবায়ন করতে তারা ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ধাপে কাজ শুরু করেছে। প্রথম ধাপে কর্মীদের চাঙ্গা করতে তাদের একটি টিম সম্প্রতি সারা দেশ ঘুরে এসেছে। দ্বিতীয় ধাপে এখন তারা টার্গেট করা ব্যক্তিদের হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে। এক্ষেত্রে দেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন  পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মুক্তমনা ব্লগার, প্রকাশক তাদের টার্গেটে রয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে অপারেশন শেষ হলে জনসভা, শপিংমল, সিনেমা হলসহ জনসমাগম বেশি এমন স্থানে ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় তাদের বড় ধরনের হামলা চালানোর ফন্দি রয়েছে বলেও জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। এদিকে কারাগার সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, কারাগারে বসেই সারা দেশের জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে মহিউদ্দিন ও গোলাম মাওলা। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক হচ্ছেন অধ্যাপক মহিউদ্দিন। তার অবর্তমানে সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ড. গোলাম মাওলা। উভয়েই এখন কারাবন্দী।

সর্বশেষ খবর