শনিবার, ২১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ক্ষোভ বিক্ষোভ অব্যাহত

শিক্ষককে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষোভ-প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। আজও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা-কর্মীরা শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার প্রতিবাদে কান ধরে উঠবোস করেন। সেখানে এক সমাবেশে এ প্রতিবাদে জানানো হয়। এ সময় ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যালঘুদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও তাদের প্রতি অবহেলামূলক আচরণ করছে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, ‘সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে এ দেশের সংখ্যালঘুরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় তাদের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, যেভাবে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, আমরা এর প্রতিকার চাই।’ এদিকে যশোরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক সভায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘সারা দেশের মানুষ এখন শ্যামলকান্তির পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এভাবেই দাঁড়াতে হবে। এখন ওসমান পরিবারের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই শিক্ষক শ্যামলকান্তিকে স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে। তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা শিক্ষক শ্যামলকান্তিকে গতকাল বেলা ১১টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্ত্রীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয় বলে জানা গেছে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার শরীরের বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তবে চিকিৎসাধীন এই শিক্ষক নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ মানেই ওসমান পরিবার। যে কোনো মুহূর্তেই আমার ওপর হামলা হতে পারে। আমার অবস্থাও সাত খুন ঘটনার মতো হতে পারে।’ এর আগে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মো. শফিউল আলম ফেরদৌস জানান, হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকরা থাকায় তাকে পেছনের গেট দিয়ে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। শ্যামলকান্তির শরীরের অবস্থা ভালো নয়। কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলায় তার ব্রেনের ওপর চাপ পড়ছে। এতে তিনি আরও অসুস্থ বোধ করছেন। খানপুরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসা তত্ত্বাবধায়কের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে শ্যামলকান্তির স্ত্রী একটি আবেদন করেন। এতে বলা হয়, উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি তার স্বামীকে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে নিতে চান। পরে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। গত শুক্রবার জাতীয় পার্টির স্থানীয় এমপি এ কে এম সেলিম ওসমান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে শ্যামলকান্তিকে মারধর ও কান ধরে উঠবোস করানো হয়। ওই দিন খানপুরের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। গতকাল সকালে যশোর প্রেসক্লাবে ‘চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অবসানে সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘শ্যামলকান্তি লাঞ্ছনার ঘটনায় সারা বাংলাদেশ তার পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন সরকার বাধ্য হয়েছে তার চাকরি ফিরিয়ে দিতে এবং ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করতে। আমরা আশা করছি, আরও পদক্ষেপ এবং এই এমপির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা তাই মনে করি, জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবিলা করে, এমন কোনো সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি নেই, যারা বাংলাদেশকে পেছনে নিতে পারে কিংবা মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ধ্বংস করতে পারে।’ সকালে সোনারগাঁর মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় বোরাক বাস সার্ভিস উদ্বোধন শেষে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকারের পাঁচ বছরের অর্জন পাঁচ মিনিটে শেষ হতে পারে। তাই সবাইকে আরও সতর্ক হতে হবে। প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে তাকে পুনর্বহাল ও কার্যকরী কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের এক সমাবেশে শিক্ষক লাঞ্ছনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেছেন, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক লাঞ্ছনায় জড়িতদের জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। শ্যামলকান্তি ভক্তের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার এবং কমিটি ভেঙে দেওয়ায় বক্তারা সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। পরে একই স্থানে বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক প্রতিবাদী মানববন্ধনে সেলিম ওসমানসহ জড়িতদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, জাতীয় প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন। এদিকে শ্যামলকান্তি ভক্তের ওপর নির্যাতনে অভিযুক্ত সেলিম ওসমানের বিচার দাবিতে আজ বিকালে সংহতি সমাবেশ আহ্বান করেছেন লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সাংস্কৃতিক কর্মীরা। কর্মসূচি দিয়েছেন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও।

সর্বশেষ খবর