বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

প্রতিক্রিয়াশীলতার চকচকে চাপাতির নিচে

রোবায়েত ফেরদৌস

প্রতিক্রিয়াশীলতার চকচকে চাপাতির নিচে

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান দেখে বহুমুখী জ্যোতির্ময় লেখক হুমায়ুন আজাদ আশির দশকে খেদোক্তি করেছিলেন এই বলে যে, আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ জীবন অতিবাহন করছি; আর বর্তমান বাংলাদেশ দেখে আমার প্রতীতি জন্মাচ্ছে, এখন ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারালো চাপাতির নিচে’ আমরা জীবনোপায় খুঁজে বেড়াচ্ছি। হুমায়ুন আজাদ নিজেও কোপের শিকার হয়েছিলেন— তারই উপন্যাসের মতো জঙ্গিরা তাকে চাপাতি দিয়ে ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদে’ পরিণত করেছিল। দেশ তবে কোন দিকে এগোচ্ছে? সত্য বটে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, সমান্তরালে চাপাতির কোপও বাড়ছে, এটাও সমান সত্য। মানুষের জীবন আর জীবনের নিরাপত্তা যদি না থাকে কী করব এই প্রবৃদ্ধি-জিএনপি-জিডিপি দিয়ে? কী লাভ পার-ক্যাপিটা ইনকামের হিসাব কষে? আমরা যে ধর্মাবলম্বীই হই না কেন প্রতিক্রিয়াশীলের চাপাতির কোপের রেঞ্জের বাইরে আমরা কেউ-ই নই। টার্গেট যেন সবাই! সবার নামেই মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা আছে; অপেক্ষা কেবল এক্সিকিউশনের! এ যেন ‘জন্ম মানেই আজন্ম মৃত্যুদণ্ড বয়ে বেড়ানো’।

গেল ২৩ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও ২৪ মে প্রথম আলো দেশে জঙ্গি হামলা ও তাদের বিস্তার নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে; বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম, ‘কিলিং মিশনের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক’। প্রথম আলোর শিরোনাম, ‘জঙ্গি হামলা ও হত্যা বেড়েই চলেছে’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিলিং মিশনের নেটওয়ার্ক। একের পর এক তাদের টার্গেট বাস্তবায়ন করছে নেটওয়ার্কের দুর্ধর্ষ সব সদস্যরা। হিসেবে দেখা গেছে গত দেড় বছরে দেশে জঙ্গি হামলা ও হত্যার হার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চারটি হামলায় ১১ জন নিহত হন। এ বছরের একই সময়ে হামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩; নিহত হয়েছেন ১৪ জন (প্রথম আলো, ২৪ মে)। বই মেলায় লেখক অভিজিৎ রায় হত্যার মধ্য দিয়ে জঙ্গি হামলার ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোচনায় আসে। গত ১৬ মাসে ৪২টি হামলায় ৪৪ জন নিহত হয়েছেন। হামলাকারীদের কৌশলের কাছে বারবার পর্যুদস্ত হচ্ছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। একটি হামলারও সদগতি করতে পারেনি তারা। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের পরই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে চলে আসছে আনসার আল ইসলাম, একিউআইএস এবং আইএসের দায় স্বীকারের বার্তা। লেখক, প্রকাশক, ব্লগার, বিদেশি নাগরিক, সাধু, ফাদার, বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক, সমকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী, মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম— সবাই কোপ খেয়েছেন। কত বীভৎস এই সব হত্যাকাণ্ড! এখানে মুসলিম অমুসলিম সবাই কোপ খাচ্ছে; কে নিরাপদ তাহলে? রাষ্ট্র কী কারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? এর মধ্যে বড় হাস্যকর হয়ে ধরা দেয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য। তিনি বিভিন্ন সময় বলার চেষ্টা করেছেন, সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তাকে কে বোঝাবে, একের পর এক একই আদলে হামলা হতে থাকলে সেটা আর বিচ্ছিন্ন থাকে না, একই সূত্রে গাঁথা হয়ে যায়, হত্যার একটা প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সংস্থাও বলছে একটির সঙ্গে অপরটির মিল আছে।

পুলিশ প্রশাসন নিজেদের ভাঁড়ে পরিণত করেছে, বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে। ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যার প্রতিটি মামলার তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। তিনি জানিয়েছেন, সারা দেশে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট ২১টি মামলার মধ্যে ১৬টির রহস্য উদঘাটনে পুলিশ সক্ষম হয়েছে। আবার চাঞ্চল্যকর অভিজিৎ রায় ও ফয়সল আরেফিন দীপনের হত্যাকারীদের অনেকেই বিদেশে পালিয়ে গেছে বলেও দাবি করেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বললেন, এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘বিশেষ মনোযোগ’ দেওয়ার সময় এসেছে। পরিকল্পিত খুন যেগুলো এরই মধ্যে হয়েছে, সেগুলো ভাবনার বিষয়। এটি স্পেশাল অ্যাফোর্ট দেওয়ার বিষয়। (২৯ এপ্রিল মানব কণ্ঠ) আহা! এতদিনে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! রহস্য উন্মোচন হলো কিন্তু একটি হামলা-মামলার কূলকিনারা হলো না! ভাঁড়ামো ছাড়া এটা আর কী হতে পারে! অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের সরকারই ধরতে চায় না বলে দাবি করেছিলেন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। একই সঙ্গে তিনি এও দাবি করেছিলেন, যাদের ধরা হয়েছে, তাদের কেউই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়। ৩ মে জার্মান সংবাদ মাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ দাবি করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকায় হাসপাতালে থাকতে পুলিশ সন্দেভাজন যে পাঁচজনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আমাকে দেখিয়েছিল, তাদের কাউকেই এখনো গ্রেফতার করা হয়নি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা কেউই হত্যার সঙ্গে জড়িত নয়।’ (বাংলা ট্রিবিউন ৩ মে)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটা বলতে ভালোবাসেন যে, দেশে জঙ্গি তত্পরতা থাকলেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস’র কোনো অস্তিত্ব নেই। তার দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তত্পরতায় অনেকদিন ধরেই দেশীয় জঙ্গিরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। কোথাও তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা অনেকেই কারাগারে আছে। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে (বাসস ২১ এপ্রিল)। বিচার হচ্ছে? আদৌ কি বিচার হচ্ছে? জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আছে— তাহলে কোপ বন্ধ হচ্ছে না কেন? যেখানে এক থেকে দেড় বছরে ৪২টি হামলায় ৪৪ জন নিহত হয়েছেন সেখানে তিনি এ দাবি করেন কীভাবে? আমরা এটা অবশ্যই বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। কিন্তু জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের ধুয়ো তুলে প্রতিদিন সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় যেসব বক্তৃতাবাজি করে বেড়াচ্ছেন, মানুষ তাতে হাসছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীদের দায়ী করে বলেছেন, দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে ‘বেছে বেছে হত্যার’ এ পথ নিয়েছে তারা। (আলোকিত বাংলাদেশ, ৩০ মে) ঘটনা যদি সত্যি হয় তবে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? অভিজিৎ রায়ের স্ত্রীর দাবি, প্রকৃত খুনিদের পুলিশ ধরছে না, বিভিন্ন মন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের ওপর এসব হামলার দায় চাপাচ্ছে। বিষয়টা কি ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের রাস্তা করে দিচ্ছে না?

বিশ্বজুড়ে আইএস তাণ্ডব চালাচ্ছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না, এটা কি হলফ করে বলা যায়? সিরিয়া বা আফগানিস্তান বা পাকিস্তান থেকে এখানে আইএস আসবে না মেনে নিলাম কিন্তু তাদের মতাদর্শের লোকদের এখানে তারা পেট্রোনাইজ করতে পারবে না— এটা মেনে নেওয়া কঠিন। এদের অভিন্ন লক্ষ্য, খেলাফত প্রতিষ্ঠা। তাই হাত মেলাতে কতক্ষণ! পুলিশ ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’ গঠন করেছে। এরও কোনো সুফল আমরা পাচ্ছি না। কবে মিলবে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার? কারণ, একটা হত্যাকাণ্ডের বিচার করা গেলে, তার রায় কার্যকর করা গেলে এমন অপরাধ কমে আসতে বাধ্য। আর সরকার সেটা না করে একে ওকে গালাগাল দিচ্ছে। ফলে সুযোগ সন্ধানী মহল আরও সুযোগ নিচ্ছে। স্পর্শকাতর এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আর কত সময় লাগবে? আর কত হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হবে? ভুলে গেলে ভুল হবে যে, নিকটতম সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে শাস্তির আওতায় না আনতে পারলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। মদদদাতারাও তাদের ‘কিলিংপলিসি’ থেকে সরে আসবে না।

আরেকটি তথ্য, গত দুই বছরে অন্তত ৩০ জন ব্লগার নিরাপত্তা না পেয়ে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে গেছে (বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ এপ্রিল)। দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়ায় আরও ঠিক কতজন আছেন, তার কোনো হিসাব নিরাপত্তার কারণেই জানাতে চান না কেউ। এ ছাড়া নিয়মিত হুমকি মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন অনেকেই। এই যদি হয় বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র, তবে আপনার-আমার নিরাপত্তা কোথায়? জননিরাপত্তা কি অরণ্যেই রোদন করবে? স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা তবে কে কাকে দেবে? মানুষ তাহলে রাষ্ট্র বানায় কেন? কেন-ই বা একদলকে সরকারে বসিয়ে দায়িত্ব দেয় রাষ্ট্র পরিচালনার? প্রশ্ন রইল।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; [email protected]

সর্বশেষ খবর