মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

আল কোরআন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

আল কোরআন

মাহে রমজানে ‘মানুষের দিশারী এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে’ কোরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আরবি ভাষায় ইহা অবতীর্ণ হওয়ার কারণও উল্লেখ করা হয়েছে কোরআনে— ‘(হে রসুল) আমি তোমার ভাষায় কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (৪৪ সুরা দুখান। আয়াত ৫৮); ‘আমি (সুস্পষ্ট কিতাব) অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কোরআন রূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (৪৩ সুরা যুখরুফ। আয়াত ৩); ‘আমি তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তুমি সতর্ক করতে পার মক্কা ও এর চতুপার্শ্বের জনগণকে’ (৪২ সুরা শুরা। আয়াত ৭); ’আমি যদিআজমী ভাষা য় (অর্থাৎ আরবি ব্যতিত অন্য যে কোনো ভাষায়) কোরআন অবতীর্ণ করতাম তারা অবশ্যই বলত, এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, এর ভাষা আজমি অথচ রসুল আরবীয়’ (৪১ সুরা হা মীম আস সাজদা। আয়াত ৪৪); ‘আরবি ভাষায় এই কোরআন বক্রতামুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে’(৩৯ সুরা যুমার। আয়াত ২৮); ‘আমি কোরআনকে অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় এবং তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী যাতে তারা ভয় করে অথবা তা হয় তাদের জন্য উপদেশ।’ (২০ সুরা তাহা। আয়াত ১১৩)।

মাতৃভাষায় ভাবের আদান-প্রদান যতটা স্বাভাবিক ও সাবলীল অন্য ভাষায় ততটা নয়। একজন অক্ষরজ্ঞানহীন এর পক্ষে ভাবের আদান-প্রদানে কোনো অসুবিধা হয় না নিজের মাতৃভাষায়। মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান। স্থানীয়ভাবে, নিজস্ব নিয়মে প্রাকৃতিক অবয়বে গঠিত ধ্বনি ও শব্দমালার মাধ্যমে মানুষ ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। এলাকা বিশেষে নিজেদের মধ্যে সহমর্মিতা ও সংহতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নিজস্ব ভাষা অন্যতম অবলম্বন হিসেবে কাজ করে। অঞ্চল, গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্য নির্দেশক হিসেবেও এবং নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশে বাহন হিসেবে ভাষা একটি অন্যতম নিয়ামক। জাতীয়তা বোধের বিকাশে ভাষার অবিসংবাদিত ভূমিকার কারণে ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে অনেক দেশ গোত্র ও গোষ্ঠীকে।

আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল হওয়ার মধ্যে যে উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় ও যৌক্তিকতা স্বয়ং আল্লাহরাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন তার মধ্যে চিন্তা ও উপলব্ধির অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। একজন উম্মি রসুলের কাছে তার নিজ ভাষাতে ওহি এসেছে এবং তার অনুসারীদের মধ্যে তা প্রকাশ প্রচার ও ব্যাখ্যার সুবিধার জন্য তো বটেই। কিন্তু তার চাইতেও বড় কারণ আরবি এমন একটি সমৃদ্ধ ও সুপ্রাচীন ভাষা, এর গঠন ও প্রকাশ শৈলী এমনই কাব্যিক ও সুরেলা যার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদানে ব্যাখ্যা ও বয়ানে বিশেষ আবেগ ও আন্তরিকতার আবহ সৃষ্টি হয়। বলা হয়েছে আরবি ভাষায় এ কোরআন বক্রতা মুক্ত, আর বক্রতা মুক্ত বলেই এর বাণী সবার কাছে সার্বজনীন সাবধানতা অবলম্বনের জন্য, হেদায়াতের জন্য, অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট কার্যকর। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় মাহে রমজানে রসুল (দঃ)-এর মাধ্যমে মানুষের কাছে কোরআন হিসেবে প্রথম যে শব্দ বা বাণী অবতীর্ণ হয়েছে তা হলো ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়। বলা হলো পাঠ কর সেই প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না। কোরআন হলো মানুষকে শিক্ষার দিকে জ্ঞান আহরণ আর উপলব্ধির দিকে অনিবার্য আহ্বানের এক ঐশী সওগাত যা মাহে রমজানেই পাঠানো হয়েছে।

কোরআন মজিদের তাত্পর্য ও ভূমিকা প্রসঙ্গে আল-কোরআনেই এ মহান কিতাবকে বিভিন্ন বিশেষ নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন ‘আল কিতাব’ -মহাগ্রন্থ (২ঃ২) , ‘আল ফুরকান’—ভালো ও মন্দের পার্থক্য নির্দেশকারী (২৫ঃ১ ); ‘আজ জিকর’—মানুষের প্রতি খোদা প্রদত্ত মহিমা স্মরণ করিয়ে দেওয়া (১৫ঃ৯); ‘আল মোয়াইজাহ’- বিশেষ উপদেশ (১০ঃ৫৭); ‘আল হুকুম’- বিচারের রায় (১৩ঃ৩৭); ‘আল হিকমত’- প্রজ্ঞা (১৭ঃ৩৯); ‘আশ শিফা’- আরোগ্য দানকারী (১০ঃ৫৭); ‘আল হুদা’ - সঠিক পথ প্রদর্শক (৭২ঃ১৩); ‘আত তানজিল’ - অবতীর্ণ ঐশী বাণী (২৬ঃ১০২); ‘আর রহমত’ -দয়া (১৭ঃ৩২); ‘আর রুহ’ - জীবনদানকারী আত্মা (৪২ঃ৫২); ‘আল খায়ের’ - উত্তম স্তভাব (৩ঃ১০৩); ‘আল বায়ান’-উত্তম ব্যাখ্যাকারী (৩ঃ১৩৭); ‘আন নিয়মত’- কল্যাণ (৯৩ঃ১১); ‘আল বুরহান’- স্তচ্ছ যুক্তি (৪ঃ১৭৫); ‘আল কাইইম’- উত্তম ব্যবস্থাপক (১৮ঃ২); ‘আল মোহাইমিন’-উত্তম অভিভাবক (আগের কিতাব সুমুহের) (৫ঃ৪৮); ‘আননুর’ -আলো (৭ঃ১৫৭); ‘আল হক’-সত্য (১৭ঃ৮১); ‘হাবলুল্লাহ’-খোদার নির্দেশনা (৩ঃ১০২) ইত্যাদি। মাহে রমজানের অশেষ কল্যাণ ব্যক্তি তথা সমাজ জীবনে নিশ্চিত করতে আল-কোরআনের মহান শিক্ষা ও নির্দেশনা এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। আল কোরআন এবং মাহে রমজান পারস্পরিক সূত্রে গাঁথা এবং মানবতার সার্বিক কল্যাণে এক অবিনশ্বর অবলম্তন। আধুনিক বিশ্বে মানবতার আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, নৈতিকতা ও আদর্শিক মূল্যবোধের বিকাশ অতীব প্রয়োজন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর