রবিবার, ১০ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঈদে রক্তাক্ত শোলাকিয়া

দুই পুলিশ সদস্য ও ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নারী নিহত । হামলাকারী এক জঙ্গি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র

নিজস্ব প্রতিবেদক ও কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

ঈদে রক্তাক্ত শোলাকিয়া

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে দুই হামলাকারী অস্ত্র হাতে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় সশস্ত্র হামলার শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঈদের দিন রক্তাক্ত হলো কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া। বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য যখন দেশের সর্ববৃহৎ এই ঈদগাহের দিকে মানুষের স্রোত, ঠিক তখনই সন্ত্রাসীরা দায়িত্বরত পুলিশের ওপর বোমা হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ বাধে সন্ত্রাসীদের। সংঘর্ষে দুই পুলিশসহ চারজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে একজন গৃহবধূ রয়েছেন, যিনি ঘরের ভিতর গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। নিহত অন্যজন হামলাকারী। আহত হন ১২ জন, যাদের অধিকাংশই পুলিশ।

নিহতরা হলেন কনস্টেবল জহুরুল হক (৩০) ও আনসারুল (৩৫), গৃহবধূ ঝরনা রানী ভৌমিক এবং হামলাকারী আবীর রহমান (২২)।

আহত পুলিশ সদস্যদের প্রথমে কিশোরগঞ্জ এবং পরে গুরুতর ছয়জনকে হেলিকপ্টারে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচে) পাঠানো হয়। হামলার পর নির্দিষ্ট সময়েই ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হলেও শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠে যেতে পারেননি অনেকেই। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে আটক করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, গুলশানে হামলাকারী জঙ্গিরাই শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছে।

ঈদের সকালে বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির ঘটনায় শোলাকিয়া মাঠের ঈদ জামাতে অংশ নিতে জড়ো হওয়া মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কথা ছিল, বরাবরের মতোই মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ঈদের জামাত পরিচালনা করবেন। কিন্তু এই গোলযোগের মধ্যে তিনি না পৌঁছানোয় শেষ পর্যন্ত স্থানীয় বড়বাজার জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা শোয়াইব আবদুর রউফের ইমামতিতে শোলাকিয়ার ঈদ জামাত হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীদের টার্গেট ছিল ঈদের জামাত ও শোলাকিয়ার মূল ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। সেই টার্গেট নিয়েই তারা এগোচ্ছিল। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুই পুলিশের প্রাণের বিনিময়ে ব্যর্থ হয়ে গেছে শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসীদের বড় ধরনের টার্গেট। আর সন্ত্রাসীরা সফল হলে শোলাকিয়া হতো এক মৃত্যুপুরীর নাম। ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলাকারী চক্রটিই শোলাকিয়া ঈদগাহর পাশে হামলার ঘটনায় জড়িত। পুলিশের দক্ষতা ও নিরাপত্তা জোরদার থাকায় আমরা অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। সহিংসতার খবর ঈদগাহ মাঠে পৌঁছলেও অনেক মানুষ পদদলিত হয়ে মারা যেত।’

কিশোরগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার ওবায়দুল হাসান জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শোলাকিয়া মাঠের আড়াইশ’ মিটারের মধ্যে আজিমুদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ফটকের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পর বেলা ৩টার দিকে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ এলাকার আশপাশে অভিযানে নামে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে আসা র‌্যাবের কমান্ডো টিম। তাদের সঙ্গে র‌্যাবের বোমা ডিসপোজাল টিমও অভিযানে ছিল। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সদস্য এলাকাটি ঘিরে রাখেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল ও একটি চাপাতি উদ্ধার এবং আহত অবস্থায় দুই সন্ত্রাসীসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে।

আটকরা হলেন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার আবদুল হাইয়ের ছেলে শরিফুল ইসলাম ওরফে আবু মোকাত্বিল (২২) ও কিশোরগঞ্জের পশ্চিম তারপাশা এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক (২০)। অন্যজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, দেশের সবচেয়ে বড় শোলাকিয়ার ঈদ জামাত শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। কিন্তু ভোর থেকে হাজার হাজার মুসল্লি পায়ে হেঁটে শোলাকিয়ার দিকে আসতে থাকেন। রাস্তার দুই পাশে এবং মাঠের আশপাশে অবস্থান নেন র‌্যাব-পুলিশের কয়েক হাজার সদস্য। আগেই শহরে মাইকিং করা হয়েছিল নিরাপত্তার স্বার্থে মুসল্লিরা যেন জায়নামাজ ছাড়া অন্য কিছু সঙ্গে না আনেন। সে অনুযায়ী মাঠে যাওয়ার সময় টহল পুলিশ মুসল্লিদের তল্লাশি করছিল। সকাল পৌনে ৯টার দিকে শোলাকিয়া ঈদগাহর ওপর দিয়ে একটি হেলিকপ্টার চক্কর দেয়। এ সময় শোলাকিয়ার মাইকে বলা হয়, ইমাম সাহেব এসেছেন হেলিকপ্টারে করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মাঠে আসছেন। এর কিছুক্ষণ পরই শোলাকিয়া মাঠের অদূরে শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে মুফতি মোহাম্মদ আলী জামে মসজিদের মোড়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের ওপর বোমা হামলা করে সন্ত্রাসীরা।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, মুসল্লি বেশে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। সকাল ৯টার দিকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা পাঁচ-ছয়জনের একটি দলকে তল্লাশি করছিল। এ সময় মুসল্লি বেশে সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তারা প্রথমে বোমা ফাটিয়ে, কুপিয়ে সাত পুলিশ সদস্যসহ আটজনকে গুরুতর আহত করে। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম। পরে ময়মনসিংহ সামরিক হাসপাতালে মারা যান অন্য পুলিশ কনস্টেবল আনসারুল ইসলাম।

এদিকে ঘটনার পরপরই অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে আসার পরপরই একই এলাকায় ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে হামলাকারীরা মসজিদ-সংলগ্ন একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ও গুলি চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি হয়। এ সময় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই বাড়িটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বেলা ১১টার দিকে ওই বাড়ি থেকে এক সন্ত্রাসী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। বেলা ১২টার দিকে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় র‌্যাব, বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনী। এর কিছুক্ষণ পরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম নূরুজ্জামান ঘটনাস্থলে আসেন। এর পরই তার নেতৃত্বে শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান।

এক সপ্তাহ আগে জঙ্গিদের অবস্থান : গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, হামলাকারীরা সপ্তাহখানেক আগেই কিশোরগঞ্জে আসে। হামলাকারীদের মূল টার্গেট ছিলেন শোলাকিয়া মাঠের ইমাম। কিন্তু এর আগে চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যদের মুখোমুখি হয়ে গেলে কোনো উপায় না দেখে হামলাকারীরা ওখানেই হামলা শুরু করে দেয়। পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর আটক এক সন্ত্রাসী পুলিশকে জানায়, তারা পাঁচজনের একটি দল ২৭ জুন এ অপারেশন চালাতে কিশোরগঞ্জে এসেছে। তবে কার নির্দেশে তারা হামলা করেছে তা এখনো জানা যায়নি।

ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন জঙ্গি : ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পুলিশের ওপর হামলা করে। তারা বোমা নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে চাপাতি দিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তারা পুলিশ সদস্যদের জখম করে। পুলিশ গুলি চালালে তারাও দ্রুততার সঙ্গে পাল্টা গুলি ছোড়ে। হামলাকারীরা সবাই যুবক বয়সী। তাদের প্রত্যেকের বয়স ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে। তারা মুসল্লিদের সঙ্গে মিশে পুলিশের কাছাকাছি চলে আসে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিত হামলা চালায়।

বিশেষ পোশাক : পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হামলার সময় নিহত জঙ্গি আবীরের পরনে যে পোশাক ছিল, সেখানে চাপাতি রাখার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। নীল রঙের ওই পোশাকের ভিতর বিশেষ কায়দায় চাপাতিজাতীয় অস্ত্র রাখার পকেট ছিল। হামলাকারীর পরনে ছিল নীল রঙের ঢোলা পাঞ্জাবি ও ঢোলা পায়জামা। পায়জামার ভিতর চাপা জিন্সের প্যান্ট পরা ছিল। চাপাতিজাতীয় লম্বা অস্ত্র রাখার জন্য প্যান্টের মধ্যে কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত বিশেষ পকেট বানানো ছিল। হামলাকারীদের পরিকল্পনা ছিল, হামলার পর পোশাক পরিবর্তন করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া।

রুখে দিয়েছে পুলিশ : রাজধানীর গুলশানের পর শোলাকিয়ায়ও সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে জীবন বাজি রাখে পুলিশ। আর এ সাহসের কঠিন মূল্য দিয়ে জীবন দিতে হয়েছে দুই পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল হক (৩০) ও আনসারুল হককে (৩৫)। এ দুই পুলিশের প্রাণের বিনিময়ে ব্যর্থ হয়ে গেছে শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসীদের বড় ধরনের টার্গেট। সন্ত্রাসীরা সফল হলে শোলাকিয়া হয়তো হতে পারত এক মৃত্যুপুরীর নাম। তারা প্রথমে শক্তিশালী হাতবোমা ছোড়ার পরপরই অ্যাকশনে যায় পুলিশ। এ ঘটনায় দুজন পুলিশ সদস্য নিহত ও ছয়জন আহত হয়েছেন। নিহত দুই পুলিশ সদস্যকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দিয়ে।

এ ঘটনায় মূলত সন্ত্রাসীরা নিজেদের ছক কাটা মিশন সফল করতে পারেনি। আটক দুর্বৃত্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বেরিয়ে আসবে। তবে পুলিশের ধারণা, দেশীয় সন্ত্রাসী বা জঙ্গিরাই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।

নিজ ঘরে গুলিবিদ্ধ ঝরনা : কিশোরগঞ্জ শহরের চর শোলাকিয়া সবুজবাগ এলাকার ভৌমিক নিবাসে কান্নার রোল বয়ে যাচ্ছে। ঈদের দিন জঙ্গি হামলার সময় এ বাড়ির গৃহিণী ঝরনা রানী ভৌমিক নিজ ঘরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী হলেও এ পরিবারটি অসাম্প্রদায়িক হিসেবে এলাকায় পরিচিত। প্রতি বছর ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদগাহে আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে নিজ বাড়ির সামনে জগ ও গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন এ পরিবারের শিশু ও পুরুষ সদস্যরা। তৃষ্ণার্ত মুসল্লিদের পানি পান করিয়েই তারা তৃপ্তি পান। এবারও তেমনটিই করছিলেন তারা। অন্যদিকে ঈদের আনন্দ নিজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি করার জন্য রুটি ও সেমাই রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী ঝরনা রানী ভৌমিক। ঘড়ির কাঁটায় যখন সকাল পৌনে ৯টা, তখনই ঘটে জঙ্গি হামলার ঘটনা। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। পুলিশও পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে ঘরের স্টিলের জানালা ভেদ করে একটি গুলি ঝরনার মাথায় বিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। রক্তে সয়লাব হয়ে যায় ঘরের মেঝে।

ক্যামেরায় দুই জঙ্গির অ্যাকশন দৃশ্য : শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার সময় দুই জঙ্গির অ্যাকশনের দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরায়। ঘটনাস্থলের পাশে ১৬৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি পাঁচতলা বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো ছিল। এতে হামলার দৃশ্য ধারণ করা আছে। ঘটনার পর পুলিশ, র‌্যাব ও সংবাদকর্মীরা এ ফুটেজ সংগ্রহ করেন।

ফুটেজে ধারণকৃত দৃশ্যে দেখা যায়, দুই জঙ্গির মধ্যে একজনের হাতে একটি পিস্তল ও বোমা। তার পরনে ছাই রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি ও মাথায় টুপি ছিল। নীল রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত অন্য যুবকের হাতে একটি পিস্তল ও একটি চাপাতি ছিল। অস্ত্র নিয়ে তাদের দৌড়াতে এবং হামলা করতে দেখা যায়। দৃশ্যে পুলিশকেও পাল্টা হামলা করতে দেখা যায়। কয়েকজন পথচারীকেও দৌড়াতে দেখা গেছে ফুটেজে। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নীল রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক নিহত হন। তার নাম আবীর রহমান। অন্যদিকে ছাই রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। তার নাম সাইফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ওরফে মুত্তাদিল (২৭)। তার বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ গ্রামে।

কনস্টেবল আনসারুলের বাড়িতে ঈদ পরিণত হলো শোকে : ঈদের জামাত শুরুর আগে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কাছে বোমা হামলায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল আনসারুল হকের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলায়। ত্রিয়শ্রী ইউনিয়নের দৌলুতপুর গ্রামের মৃত সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে আনসারুল। সরেজমিনে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধ মা রাবেয়া খাতুন ছেলের কথা বলে বলে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। স্ত্রী লুনা আক্তারও বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়েন। আর থেকে থেকে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি এখন কার কাছে যাব! কার কাছে থাকব!’ এভাবেই ঈদের দিন পুরো বাড়িতে সকাল থেকে চলে শোকের মাতম।

সন্ধ্যার পর পুলিশ সদস্যরা দৌলতপুরে নিজ গ্রামে আনসারুলের লাশ নিয়ে পৌঁছান। পুরো বাড়িতে শত শত লোক ভিড় জমিয়েছেন আনসারুলের লাশ এক নজর দেখতে। মিলনবাজার ঈদগাহ মাঠে সম্পন্ন হয় তার দ্বিতীয় জানাজা। পারিবারিক গোরস্থানে আনসারুলের লাশ সমাহিত করা হয়।

এ সময় জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান, পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খান আবু নাসেরসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার ও বাইরে থেকে আসা অসংখ্য মানুষ শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। জানা যায়, মৃত সিদ্দিকুর রহমানের চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আতিক একটি দুর্ঘটনায় কয়েক বছর আগে মারা যান। এরপর আতিকের দুই ছেলে, মা আর দুই ভাইকে দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে আনসারুলের ওপর। ২০০৬ সালে আনসারুল পুলিশে যোগ দেন। এরপর কেন্দুয়া উপজেলার পাচাহার কোনাপাড়া গ্রামে বিয়ে করেন। মৃত্যুর সময় নিঃসন্তান ছিলেন আনসারুল।

ফুলবাড়ি : শুক্রবার ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়নের ভাটিপাড়া বালাশর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় অনবরত বিলাপ আর চোখের জল বুকে ফেলে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নিহত পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপুর (২৪) মা রোকেয়া খাতুন। তিনি কোনভাবেই মেনে নেতে পারছেন না ছেলের অকাল প্রয়াণ। মৃত্যুর প্রথম দু’দিন তিনি কিছুই মুখে তুলতে পারেননি। তপুর মা রোকেয়া খাতুনের পাশেই বসা ছিলেন বড় ভাই দেলোয়ার হোসেন। নীরব কান্নায় তারও চোখ ছল ছল করছিল।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তপুর নিজ গ্রামে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) হারুন অর রশিদ, ফুলবাড়িয়া থানার ওসি রিফাত খান রাজিব, ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাদীসহ স্থানীয় এলাকাবাসী অংশ নেন। জানাযা শেষে বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় পুলিশের এই বীর সেনাকে। এ সময় গোটা এলাকায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

হামলাকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র : কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে গোলাগুলির মধ্যে নিহত হামলাকারী যুবক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবীর রহমান (২২)। তিনি চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। আবীরের বাবার নাম সিরাজুল ইসলাম। বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে। ঢাকায় তাদের বাসা ভাটারা থানা এলাকায়। আবীরের বড় ভাই আশিকুর রহমান গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও দেখে তাকে শনাক্ত করেন। মার্চ থেকে তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে তার বাবা ঈদের আগের দিন ঢাকার ভাটারা থানায় একটি জিডি করেছেন বলে ওই থানার ওসি নুরুল মোত্তাকিন জানিয়েছেন।

ওসি নুরুল মোত্তাকিন বলেন, ৬ জুলাই আবীরের বাবা সিরাজুল ইসলাম ছেলে নিখোঁজের বিষয়ে থানায় জিডি করেন। ১ মার্চ থেকে আবীর নিখোঁজ ছিলেন বলে তিনি জানান। এতদিন পরে জিডি করার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন বলে জানান ওসি। জবাবে সিরাজুল ইসলাম পুলিশকে বলেছেন, ‘বিদেশে যাওয়া নিয়ে রাগ করে ছেলে বাসা থেকে বেরিয়েছিল। ও মালয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, দুই ভাই অস্ট্রেলিয়ায় থাকে সেখানে যাও। এ নিয়ে কথাকাটাকাটির পর বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ভেবেছিলাম, মালয়েশিয়ায় গেছে। নিজেই ফিরে আসবে। কিন্তু গুলশানে হামলার পর মনে সন্দেহ হওয়ায় থানায় এসেছি।’ ২২ বছর বয়সী আবীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের একজন নিবরাস ইসলামও ঢাকার এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনিও কয়েক মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর