রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অপরাধনামা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের স্বাধীনতাকামী বাঙালির আতঙ্কের অন্য নাম ছিল মীর কাসেম আলী ওরফে ‘কসাই’ কাসেম। তার হাতে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও বাঙালি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হন। হত্যা ও নির্যাতনে পারদর্শিতার পুরস্কার হিসেবে তাকে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ছাত্রসংঘকে যখন আলবদর বাহিনীতে পরিণত করা হয় তখন মীর কাসেম আলী এ বাহিনীর তিন নম্বর ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। তখন আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী এবং দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের ওপর তার অত্যাচার-নির্যাতনের ধরন-ধারণ দেখে সে সময় নির্যাতিতরা তাকে “কসাই কাসেম” নামে অভিহিত করেন। পরে এ নামেই ডাকা হয় তাকে। মীর কাসেম ডালিম হোটেলে শত শত বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডালিম হোটেল থেকে অনেক বাঙালিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।’ মীর কাসেমের হাতে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী আমার ওপর চালায় অমানুষিক নির্যাতন। পা ওপর দিকে বেঁধে রড দিয়ে পেটানো হয়। দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক শক।’

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্টে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামের নন্দনকানন টিঅ্যান্ডটি অফিসের পেছনে হিন্দু মালিকানাধীন ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে নেন। ভবনটি নিয়ন্ত্রণের পর আলবদর বাহিনী এর নামকরণ করে ‘ডালিম হোটেল’। দখলের পরই ‘মহামায়া ভবন’ হয়ে যায় মুক্তিকামী বাঙালিদের অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন বাঙালিকে ডালিম হোটেলে ধরে এনে চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। পেটানো হতো রড দিয়ে এবং দেওয়া হতো বৈদ্যুতিক শক। নির্যাতনের শিকার বেশির ভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও প্রগতিশীল দলের কর্মী-সমর্থক। ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার লোকজন যখন পানি চাইতেন তখন রাজাকাররা প্রস্রাব করে তা পান করতে দিত। যখন মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্রাব পান করতে চাইতেন না, তখন নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে প্রস্রাব পান করতে বাধ্য করত মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন, জীবন কৃষ্ণ শীলসহ নাম না জানা শত শত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরও ডালিম হোটেলের আশপাশ এলাকায় অসংখ্য লাশ পড়ে ছিল। ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন নাসির উদ্দিন চৌধুরী, ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খান, তৎকালীন জেলা ন্যাপের সভাপতি এ এন নূরুন্নবী, ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা অরুণ কুমার চৌধুরী, শফিউল আলম চৌধুরী, ড. ইরশাদ কামাল খান, ড. মোসলেহ উদ্দিন খান, জেলা ন্যাপের তৎকালীন নেতা অ্যাডভোকেট শফিউল আলম (বেবী শফি), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, তৎকালীন চীনপন্থি ন্যাপ নেতা মো. সেলিম ও মেজবাহ খান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মীর কাসেম আলী সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আবার দেশে ফিরে আসেন। ’৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ ছাত্রশিবিরে পরিণত হলে তাকে এর সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর